সাম্প্রতিক

মুজিব ইরম এর ‘নিশাপুর, ও অন্যান্য কবিতা

Erom 1চন্দনচারা

সেই কবে লাগিয়েছি চন্দনের চারা
একদিন ফুটাবে সে ঘ্রাণ
এই মর্মে প্রতিদিন তিলে তিলে জাগল হচ্ছে সে
স্বজনেরা গালমন্দ করে
কেনো আমি লাগাচ্ছি না সহজেই বেড়ে-ওঠা গাছ
কী দরকার এতো চন্দনের ঘ্রাণ
কী দরকার অপেক্ষা এতো
এক জীবনে না-দেখা ফল
কাজের অর্জন!
তবুও খায়েস বাড়ে
রুয়ে যেতে চন্দনের চারা তুচ্ছ করে নগদ ফলন
কোনো একদিন যদি বেড়ে উঠে ফোটায় সুঘ্রাণ
এই ভেবে রাত্রি জেগে স্বজন হারাই, অপেক্ষা বাড়াই
রুয়ে রাখি ধীরে-বাড়া চন্দনের চারা, ক্ষয় করে সোনার তনাই।

দেহকারিগর

এই ক্রন্দনশীল রাতে
ওহে শব্দকারিগর
তোমার সকাশে
উড়ে আসে শব্দরেণু উচ্ছ্বাস ভঞ্জন
হে অঙ্কনবিদ
বংশসহোদর
রেখা-বাক্য-রঙের যাতক
যারা ছিলো
গোত্র-অধিপতি
তাদের তল্লাটে
অঙ্কন করেছো তুমি ডানাহীন বায়ু
জলের ওড়াল…
গড়েছো আদল যতো
নেত্রহীন দেহগুলো বৃথা যায়
বৃথা যায়…
ওহে দেহকারিগর
অহোরাত্রি এঁকেছো যে দেহের গড়ন
কবে তবে নেত্রদিন
কবে তবে প্রাণের অঙ্কন!

লেটার প্রেস

বসে বসে ভাঙ্গা অক্ষরগুলো জোড়া লাগাচ্ছি
হাতগুলো ভিজে যাচ্ছে অবশিষ্ট কালি ও কাদায়
বানান না-জানা কম্পোজিটর  আমি
ভারি চশমায় ভিজে ওঠে অক্ষর-শরীর
শব্দ শুধু ভুল হয়
অযোগ্য অক্ষরগুলো হাতে উঠে আসে
কিছুতেই শব্দসীমা বাড়ানো গেলো না
অন্ধকার ঘরে মেশিনের কান্নাগুলো
বাঁকাতেড়া ধাতব অক্ষর হয়ে পড়ে থাকে খোপে খোপে
লেটার প্রেসের সেই
শব্দ জোড়া-দেওয়া ক্ষীণদৃষ্টি যাদুকর হয়ে
দাঁড়িকমা জড়ো করছি দিনভর
মফস্বল শহরের ঘুপসি ঘরে
পাইকা অক্ষরগুলো বেঠিক নিয়মে জোড়া লাগাচ্ছি আমি।

বংশবিদ্যা

তালগাছের কথা উঠলেই
সকলেই নারাজ
খেজুরের কথা আর কী করে তুলি
কয়েক সিঁড়ি নাকি কেটে যায় ফলবতী হতে
এই ভেবে
এই বংশে
এইসব গাছ
কেউ আর করে না রোপন
আমিও কি তাদের মতোই আস্তা হারাবো?
অনেক দিন হয়
আমাদের বংশে কোনো তালগাছ
ফলবতী হয়নি যে
ধরেনি ফলন কোনো খেজুরের গাছে
তেতুঁলের প্রাচীন ছায়ায়
দিন কেটে যায়
বড়ো আহাজারি নামে
এই বংশে রুয়ে যাই
তাল আর খেজুরের গাছ রাত্রি জেগে জেগে!

টিপসই

ক্যারোসিনের আলোয় ধরে আছি পাতা
বড়ো যত্নকরে মাখিয়েছি তেল
প্রতীক্ষা প্রহর
আলোর শিখায় ধীরে ধীরে
কালো হয়ে উঠছে
কাঁঠালের পাতা
টিপসইয়ের কালি
কতো কাল হলো
বুড়ি আঙ্গুলের কাছে জিম্মি হয়ে আছি
কিছুতেই যুৎসই হচ্ছিলো না দাগ
দস্তখত নয়
টিপসইয়ে বিশ্বাসী লোক আমি
এতো যে সময় গেলো
বুড়ি আঙ্গুলে বিশ্বাসী হতে
আজ আলোর শিখায় কালো হচ্ছে পাতা
তবু যেন যথাস্থানে টিপসই বসে না আমার!

কুলবংশ

আদি সেই কুলবংশ ত্যাগিয়াছি
জাতপাত গেছে যে আমার
নয়া বংশে মুরিদানি গছিয়াছি
হে বংশপীর
হে শব্দ-ধনপতি
বেলা যায়
তোমার ঘাটেই আমি নৌকা বাঁধিয়াছি
সুরের কলিমা তুমি কণ্ঠে তুলে দাও
হে বংশের বাতি
হে শব্দ-কুলপতি
আসিয়াছি দীক্ষা নিতে
কতো আর ঘুরিফিরি অঘাটে-কুঘাটে
আমাকে এ-বংশের পিঁড়ি পেতে দাও
বুক পেতে দাও…

নিশাপুর

নিশাপুর রক্তে জেগে ওঠে
নিশাপুরে বেজে ওঠে রাতের শরীর
প্রেমিক ও কবি যারা
একদা এ-নিশাপুরে রচিয়াছে ভাবমন্ত্র প্রেমের নিয়ম
তাপস-তাপসী তারা
তুচ্ছ করি দিনের সুরত
রাত্রিকেই বড়ো বেশি নিজ করিয়াছে
বড়ো বেশি বশ করিয়াছে
জগতের প্রেমিকারা নিশাপুরে থাকে
প্রেমিকেরা এই মর্মে রাত্রি জাগা রয়
এই মর্মে ধরে তারা আহাজারি বৈরাগ্য ফিকির…

ও কবি, তোমার বংশের চিহ্ন কি তবে নিশাপুর নয়?

Erom 2রসকলি

ভক্তি তো হলো না আর
বৃথা যায় ভক্তের হƒদয়
এই নাক
এই কপালের ভাঁজ বড়ো তৃষিত রয়েছে
এতো কাল যেভাবে এঁকেছো তুমি রসকলি– চন্দন তিলক
কী আর কহিতে পারি
অহরাত্রি শুধু শুধু মিনতি জানাই
শুধু শুধু আর্জি রাখি রোজ
চন্দনে ডুবিয়ে আনো অঙ্গুলী তোমার
অঙ্গুলীমঞ্জরী নৃত্যে মূর্ছা যাক চন্দন-লেপা এই কপাল আমার
ভাবের টানেই মাটিতে লুটাবে জানি
আমিও লুটাবো তোমার মস্তকের পাশে, রসপূর্ণ দেহ-ভরা মাঠে!

বংশটান

পরের বাড়িতে আছি পরের ঋতুতে…
তোমাকে লিখছি না
তবে কদু চাষ করছি
বীজ থেকে চারা হচ্ছে
দেখতে না দেখতে বড়ো জাগল হচ্ছে
পানি কদু
মিষ্টি কদুর গাছ
পাতাগুলো কী যে কচুয়া হয়েছে
কী যে হলহলা রঙ
বাড়িবার সাধ
সেবাযত্নে যাচ্ছে দিন
চাষী হতে চাচ্ছি ফের তোমার খাতিরে…

মুজিব ইরম বিরচিত কবিবংশ-এর সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৪। প্রকাশক : ধ্রুবপদ।  প্রচ্ছদ : চারু পিন্টু।

মুজিব ইরম

মুজিব ইরম-এর জন্ম বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার নালিহুরী গ্রামে, পারিবারিক সূত্র মতে ১৯৬৯, সনদ পত্রে ১৯৭১। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাসাহিত্যে স্নাতক সম্মান সহ এমএ। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তার ১৩টি কাব্যগ্রন্থ: মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান ১৯৯৬, ইরমকথা ১৯৯৯, ইরমকথার পরের কথা ২০০১, ইতা আমি লিখে রাখি ২০০৫, উত্তরবিরহচরিত ২০০৬, সাং নালিহুরী ২০০৭, শ্রী ২০০৮, আদিপুস্তক ২০১০, লালবই ২০১১, নির্ণয় ন জানি ২০১২, কবিবংশ ২০১৪, শ্রীহট্টকীর্তন ২০১৬, চম্পূকাব্য ২০১৭। উপন্যাস/আউটবই: বারকি ২০১১, মায়াপীর ২০০৯, বাগিচাবাজার ২০১৫। গল্পগ্রন্থ: বাওফোটা ২০১৫। শিশুসাহিত্য: এক যে ছিলো শীত ও অন্যান্য গপ ২০১৬। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে ধ্রুবপদ থেকে মুজিব ইরম প্রণীত কবিতাসংগ্রহ: ইরমসংহিতা ২০১৩, বাংলা একাডেমি থেকে নির্বাচিত কবিতার বই: ভাইবে মুজিব ইরম বলে ২০১৩, Antivirus Publications, Liverpool, England থেকে নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ: Poems of Mujib Erom 2014, ধ্রুবপদ থেকে উপন্যাসসমগ্র: মুজিব ইরম প্রণীত আউটবই সংগ্রহ ২০১৬। ## পুরস্কার: মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান-এর জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি তরুণ লেখক প্রকল্প পুরস্কার ১৯৯৬। বাংলা কবিতায় সার্বিক অবদানের জন্য পেয়েছেন সংহতি সাহিত্য পদক ২০০৯, কবি দিলওয়ার সাহিত্য পুরস্কার ২০১৪। কবিবংশ কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০১৪। শ্রীহট্টকীর্তন কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার ২০১৬।

লেখকের অন্যান্য পোস্ট

লেখকের সোশাল লিংকস:
Facebook

Tags: , , , , , , , ,

লেখকের অন্যান্য পোস্ট :

সাম্প্রতিক পোষ্ট