সাম্প্রতিক

ছবিনিবন্ধিকা : বান্নি বিহঙ্গনেত্রে / লেখা : জাহেদ আহমদ ।। ছবি : আহমদ সায়েম

আমার শৈশবের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য অংশের একটি এই বান্নি। বাংলা চৈত্রমাসের সব-কয়টি রবিবার জুড়ে এই মেলা আয়োজিত হয়ে আসছে যুগ-যুগ ধরে। স্বাভাবিকভাবেই কোনো-কোনো বছরে পাঁচটা বান্নিও অনুষ্ঠিত হয়, যে-বছর চৈত্রমাসে পাঁচটা রবিবার পড়ে যায়, নিদেনপক্ষে চারটে মেলা/বান্নি তো হয়ই। এ-বছরটি ছিল পঞ্চবান্নির বছর। চৈত্র শুরুই হয়েছে এবার রবি দিয়ে। অ্যানিওয়ে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আর্বান ট্রেইড ফেয়ার ছাড়া গ্রামীণ মেলার দেখা পাওয়া ভার। তবু যে-কয়টা আদি ও অকৃত্রিম ঐতিহ্যপ্রবাহক মেলা আছে এখনও ধুকে ধুকে টিকে, এর মধ্যে সিলেটের ঢাকাদক্ষিণের বান্নি সম্ভবত লোকসমাগম ও আয়তন বিবেচনায় শীর্ষ। ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় এখন যদিও, আমার শৈশবেও যতটুকু দেখেছি সেই শান-শওকাত এখন আর দেখি না, তবু যেটুকু আছে এখনও তা আলবৎ গরিমা করার যোগ্য।

***
মনে আছে তখনকার দিনে, এই তো বছর-বিশেক আগে, গুড্ডিহাটায় ঢুকলে দুইধার জুড়ে তো বটেই এমনকি আকাশ ঢেকে কেবল ঘুড়িরঙিন রোদ্দুর দেখা যাইত, অন্তহীন ঘুড়িস্রোত। শোলার ফুলের বিক্রেতারা বসতেন যে-লাইনটায়, সেইটা ছিল দুনিয়ার দীর্ঘতম ফুলবাগিচা। তারপর কাগজ-কঞ্চির চর্কি, আমরা বলি ফর্ফরি, এই সারিতে একবার প্রবেশিলে বেরোতে চাইত না মন। খৈ-মুড়ি-মুড়কির বিক্রেতারা আরেকটা ইয়া লম্বা লাইন বসাইতেন, পনেরো-ষোলো জাতের খৈ ছিল সেইসব বিক্রেতার সাজানো পসরায়। ক্ষিরা আর বেল বেচতে বসতেন পঞ্চাশ-একশ জন লোক দুইধার জুড়ে, মাঝখান দিয়া পায়ে হেঁটে চলার সরু গলিপথটুকু বজায় রেখে বসতেন সবাই। ছিল পুতুলনাচ দেখাবার বিরাট প্রেক্ষাগৃহ, ত্রিপল দিয়ে ঘের-দেওয়া অন্ধকার হলরুম, ঢুকলেই কিসসাকাহিনির সঙ্গে পুতুলের নাচ। একই কাহিনি দেখতাম ছোটমামার কানে ঘ্যানর-ঘ্যানর করে পটিয়ে দুইবার-তিনবার। টিকিট কেটে ঢুকতে হতো। টিকিটের হাদিয়া তো বলতে পারব না, নিজে কোনোদিন খরিদ করতে হয় নাই যেহেতু। বড় হয়ে জেনেছি এইটা নাকি ঐতিহ্য হয়ে গেছে, এবং ঐতিহ্য কাকে বলে এমন প্রশ্ন মনে উদয় হলে জিজ্ঞাসান্তে উত্তর পেয়েছি মোক্ষম : যাহা বিলুপ্ত তাহাই ঐতিহ্য! অথচ তখন এইসব ছিল অঙ্গাঙ্গী রিয়েলিটি, বাস্তবতা আমাদের শৈশবজীবনের। এখন টেলিভিশনচ্যানেলে এইসব জিনিশের অপভ্রংশ দেখায়, দেখতে পাই, এগুলোর খুব ডিমান্ড শুনতে পাই, পাপেট শো করে প্রচুর পয়সাকড়িও কামানো যায় এখন। তবে এইটা ঠিক যে, এখন অনেককিছুই বিলুপ্ত হয়ে গেলেও বান্নি টিকে আছে, এই এলাকার জন্য এইটা একটা দারুণ মর্যাদার আর গর্বের ব্যাপার। ঢাকাদক্ষিণের বান্নি দেশে-বিদেশে মশহুর, বড় হয়ে জেনেছি এসব। ছোটবেলার দীর্ঘ স্মৃতি ঘেঁটে এখন বুঝতে পারি, বান্নির মেলা এই এলাকার মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে কেমন মেশামেশি সম্পর্কিত ছিল।

***
যে-সময়টার কথা আমি বলতে চাইছি, সেই সময়ে এই অঞ্চলের লোকজন তাদের সম্বচ্ছরের গেরস্তালি জিনিশপত্তর — যেমন বাঁশ-বেতের বিবিধ তৈজশ, লাঙ্গল, কোদাল-কুড়াল-বটি, শিল-নোড়া, এমনকি সেগুনকাঠের আসবাবপত্রও এই বান্নিমেলা থেকে খরিদ করতেন সুলভ ও সাশ্রয়ী মূল্যে। আমার নানাবাড়ি ভাদেশ্বর হবার সুবাদে বান্নির সিজনে আম্মার নাইওর যাওয়া ছিল অবধারিত। ফলে বছরের-পর-বছর বান্নি ছিল কমন ইভেন্ট আমার জীবনে। এখনও চৈত্রমাসের রবিবারগুলোতে ভদ্রমহিলা মনে করিয়ে দেন একবার বান্নি থেকে একটু খৈ-ফর্ফরি কিনিয়া আনার জন্য। সব বছর তো পারি না যাইতে, এখন আমরা দুনিয়াজয়ী মহাব্যস্ত একেকজন হয়েছি তো। গতবার গিয়েছিলাম আমি, এর আগের বারও, এইবার শেষ বান্নি ধরব বলে দিলের ভিতর তামান্না আছে, দেখা যাক, যদি দুনিয়া মাথার ওপর ভেঙে না-পড়ে তো ঢুঁ দিয়া আসব একবার, খৈ কিনব, দুই-চাইরটা বেল তো অবশ্যই, তেঁতুল কিনব সারাবছরের মজুদ, হাতপাখা কিনব, ফর্ফরি তো প্রতিবারের ন্যায় এইবারও কিনব ছয়-সাত কিসিমের, প্রত্যেক কিসিম বিশটা করে। আজও পিচ্চিরা আমার শৈশবের খেলনা পেলে অ্যানিমেশন-কার্টুন-কম্পুগেইম ফেলে ঝলমলে রঙিন হয়ে ওঠে, এইটা আমি আমৃত্যু দেখে যেতে চাই। আমারই শৈশব আমি নিজের হাতে নির্ভুল ফিরিয়ে আনতে চাই প্রতিবার বান্নিমেলা এলে। এই হ্রস্বকায় নিবন্ধনোটটা, ঢাকাদক্ষিণ সিলেটের চৈতন্য-মাতুলালয় নিয়ে, আমার নিজেরও মাতুলালয় বটে, লিখে ফেলা গেল ঝটিতি কিবোর্ডে। খুব শৈশবজাগানিয়া যা-কিছু, তা আদৌ শরীরে দীর্ঘ হয় না, দ্যোতনা ও ব্যঞ্জনার দিক থেকে হয় দীর্ঘ। অশেষ এর রেশ। ফলে এই স্মৃতিনিবন্ধপ্রতিম অনুচ্ছেদখানি লিখিত হইতে পারল শৈশবতাড়নায়, বান্নিপ্রেরণায়, এই চৈত্ররজনীতে।
***
বান্নি, বারুনির মেলা, ঢাকাদক্ষিণ সিলেট, চৈত্র মাসের কোনো-এক রবিবার, বঙ্গাব্দ ১৪১৯, খ্রিস্টাব্দ ২০১২। জায়গাটা যুগপৎ শ্রীচৈতন্য ও এই নিবন্ধকের মাতুলালয়, গিয়েছিলাম বন্ধু ও কলিগ সমভিব্যহারে জনা-কয়েক। আমি, দীপক রায়, আহমদ সায়েম, মেহেদী আল মনসুর, মলয় বৈদ্য প্রমুখ। ২০১২ সালে গেছি, ১৩-তে গেছি, ১৪ গ্যাপ, ১৫-তে ফের ঘুরান্টি দিয়ে এসেছি। দ্বিচক্রবাহী মোটরবাইকযোগে, কিনেছিলাম একগাদা ফর্ফরি, খৈ, পুরান তেঁতুল, বিল্বফল প্রভৃতি। প্রত্যেকেরই হাতে ব্যাগভর্তি শৈশব ঝুলিয়ে ফিরেছি গৃহাভিমুখে, ততক্ষণে রাত সাড়ে-নয়। খেয়েছিলাম দফায় দফায় চা, ঝালমুড়ি, বিস্তর কচি ক্ষিরা খুব সাশ্রয়ী রেটে, এবং বেয়েছিলাম উঁচু-নিচু অনেক টিলা। ভালো ফোটোগ্রাফি করতে পেরেছিলেন সেদিন মশহুর কবি ও ফোটোআর্টিস্ট আহমদ সায়েম, যদিও মেলাচৌহদ্দিতে যেতে যেতে বিকেলের ধুপছায়া নেমেছিল বলে সময় ছিল খুব অপ্রতুল। তবু তীর্থে যেয়ে কেউ বটগাছের ন্যায় অলস-উদাস বসে থাকে না। যার যার মতো ভিড়ে ভেসে ফেরে, ঘেমো চৌহদ্দির সর্বত্র মহাকালের পুকার, বাঁশির আওয়াজ, হাঁকডাক, কেউ-বা হারিয়েছে তার হাতে-ধরা আত্মীয়, ক্ষণিকের উদভ্রান্ত সেই দৃষ্টির তীক্ষ্ণ ত্রস্ত ভয়, আশঙ্কার মুখমণ্ডল ওই কি এল ধেয়ে চৈত্রঝড়। ওদিকে মাইকে পূজারির ভজন, আরতি ও সংকীর্তন, কৃষ্ণভক্তদের নামগান, চৈতন্যসেবাইতদিগের লঙ্গরখানার হল্লাবোল, প্রসাদ বিতরণ ও সংগ্রহণের ইয়া লম্বা লাইন, হঠাৎ-হঠাৎ হরিবোল আর যোগাড়ধ্বনির সঙ্গে হরিলুটের তিলু-বাতাসা উৎক্ষেপণ-প্রক্ষেপণ, চৈতন্যবালকের সক্রন্দন ভক্তিগীতির মৌতাত আর থেকে থেকে খোল-করতালের মিলিত মূর্ছনা, কর্কশ কণ্ঠের উপাসনাবয়ান ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়েই মেলা, দ্য গ্র্যান্ড শো।
***
ফর্ফরি জিনিশটা আমাদের প্রিয়তম পরানভোমর। এককালে যেমন, ছিল, এমনকি এখনও। কঞ্চিকাঠির আগায় লাগানো চর্কি হাতে নিয়া বাচ্চারা ভোঁ-দৌড় দিয়া হাওয়ায় পাখা ঘুরিয়ে উড়ে বেড়ায়, এই হস্তঘূর্ণিত চর্কির আঞ্চলিক নাম ফর্ফরি। অঞ্চলের নাম সিলেট। আমাদের বন্ধু আহমদ সায়েম, যিনি একজন ভালো ফোটোআর্টিস্টও বটে, ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পেরে বেশকিছু ফর্ফরিচিত্র তুলিয়া রাখিয়াছিলেন তিনি, সেইদিন যে-মেলায় গিয়াছিলাম আমরা, বারুনিমেলা বা বান্নি নামে লোক্যালি রিনাউন্ড, সেখান থেকে ফেরার প্রাক্কালে বেশকিছু ফর্ফরিচিত্র ও গুড্ডিচিত্র তুলিয়া রাখিয়াছিলেন তার আলোকচিত্রধারক যন্ত্রে, দেখে নেয়া যায় এইখানে ফর্ফরি সচিত্র, তবে এর দরকার আর হবে না আশা করি। চিনবেন সকলেই নিশ্চয়, এইটা একেক জায়গায় একেক নামে থাকলেও অনুপস্থিত কোথাও নয়। যেমন আপনার জন্মজেলায় নিশ্চয় অন্য কোনো নামে চিহ্নিত। ছবিগুলো প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রাইট-নাও করা না-গেলেও স্থিরচিত্রকরকে এই সুযোগে কৃতজ্ঞতা জানায়ে যেতে পারি আমরা। অ্যাট-লিস্ট দুই-আড়াইখানা বান্নিপিকচার তো দেখার মওকা পাওয়া যাচ্ছে এই নিবন্ধনোটের সঙ্গে। তা, ব্যাপার অনেকটা ওই প্রপেলার-পাখার মতন, অথবা ম্যারি-গো-রাউন্ড। তবে এখন তো ওই আগের ন্যায় ম্যারি-গো-রাউন্ড তথা নাগরদোলা গাঁয়ের মেলাতেও নজরে পড়ে না। নাগরিক ফেয়ারগুলোতে, বা অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ইত্যাদি প্লেসগুলোতে, এখন নানান কিসিমের রাইড। পয়সার গাদাগুচ্ছগোষ্ঠী খর্চা করেও শব্দ হয় না হারাম। শব্দই যদি না-হইল তবে কিসের আনন্দ! কিসের ঘূর্ণিচক্র! অথচ ওই আমাদের শৈশবের অল্প পয়সার ফুর্তিগুলোতে ছিল অবারিত দৃশ্যের সঙ্গে অনর্গল শব্দের সম্মিলন। ফর্ফরি শব্দটাকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা যায় বেশ। ফরফর আওয়াজ উৎপন্ন হতো, আর ম্যারি-গো-রাউন্ডের ন্যায় নির্মল ঘুরত হাতে হাতে সুদৃশ্য উজ্জ্বল। কোত্থেকে ভেসে আসে হেমন্তকণ্ঠ, উদাত্ত : ‘দুরন্ত ঘূর্ণির ওই লেগেছে পাক / এই দুনিয়া ঘুরে বন-বন-বন-বন / ছন্দে-ছন্দে কত রঙ বদলায় / রঙ বদলায়’ …
***

শুধু ফর্ফরি বা মুড়িনাড়ুঘুড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বারুনির মেলা। অ্যাডাল্ট অভিভাবকদের মধ্যেও তখন বান্নি ছিল প্রয়োজনীয় বছরান্তের মোচ্ছব। সম্বচ্ছরের টুকিটাকি সাংসারিক কেনাকাটির বৃহদাংশ খরিদ করার জন্য এই বান্নির আগমনপথের পানে লোকে তাকিয়ে থাকত। সস্তায় কাঠমাল কেনার জন্য লোকে এককালে বিয়ে-থার জন্য উপহারসামগ্রী তথা আসবাব-উপঢৌকন বান্নি এলেই কিনত বা ভালো কারিগরের কাছে বায়না দিয়া রাখত। এছাড়া গেরস্তালি কৃষিপণ্যাদি খরিদের জন্যও বান্নি থেকে এক-লপ্তে সম্পন্ন গেরস্তেরা তাদের কেনাকাটা সারতেন। বৌ-ঝিদিগের শখের এটা-ওটা আব্দার পূর্ণকরণের হিম্মৎ সেকালের বান্নির ছিল পুরোদস্তুর। ওইদিন এখন যদিও নাই, তবু মানুষ অভ্যাসবশে মেলায় যায়, এটা-ওটা হাতে তুলে দেখে, হয়তো পুরনো দিনগুলো খুঁজে ফেরে। প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান যেন এখন মানুষ আর তার মেলাগুলো। কঠিন কঠোর দৈনন্দিনের ছায়াপাতের দিন হলেও সহজ বাঁশি আর গ্রাম্য অপটু বেহালার প্যাঁ-পোঁ সুরের ভেতরে এই মানুষ হয়তো তার প্রাণস্পন্দ খুঁজে ফেরে।

***
দুরন্ত ঘূর্ণির এই লেগেছে পাক / এই দুনিয়া ঘোরে বন-বন-বন-বন / ছন্দে ছন্দে কত রঙ বদলায় … রঙ বদলায় … / কখনো পিঙ্গল কখনো সবুজ / কখনো বুঝি আর কখনো অবুঝ / হৃদয় দিলে যার হৃদয় মেলে / হৃদয় যাবে সে কাল পথে ফেলে / গোলকধাঁধা রে ভাই, তাই লেগেছে তাক / এই দুনিয়া ঘোরে বন-বন-বন-বন / ছন্দে ছন্দে কত রঙ বদলায় … রঙ বদলায় / এই ঘুরন্ত নাগরদোলায় / কখন কাঁদায় আর কখন ভোলায় / কখন শাদা আর কখন কালো / কখন মন্দ হে কখন ভালো / জীবনজুয়ায় বীর — জিতে গেলে / বোকার হদ্দ যদি হেরে গেলে / কপাল মন্দ আজ, কাল চিচিংফাঁক / এই দুনিয়া ঘোরে বন-বন-বন-বন / ছন্দে ছন্দে কত রঙ বদলায় … রঙ বদলায় …

untitled-4-আজও চমৎকার — এই গলা, এই লিরিক্স, এই সলিলশৌর্য, এই হেমন্তমগ্নতা। হেমন্তে সুন্দর, শীতে যেমন, শরতে এবং বসন্তে-বর্ষায়। হৃদয় দিলে যার হৃদয় মেলে / হৃদয় যাবে সে কাল পথে ফেলে … আরিব্বাপ! ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে / রইব না আর বেশিদিন তোদের মাঝারে — এইটা কার লেখা আল্লা জানে, সুর কার তা-ও জানি না, আমরা ছায়াছবির গান হিশেবেই পেয়েছি এইটেকে। টেরিফিক রেন্ডিশন। এন্ড্রু কিশোর। নাকি সৈয়দ আব্দুল হাদী? কনফিউজড। তবে এন্ড্রু কিশোরই হবেন, মোস্ট-লাইক্লি, দুইয়েকবার গুনগুনিয়ে যে-টেম্প্যুটা পাওয়া যায় তাতে এন্ড্রুদ্রুতিই ধরা গেল। চলতি পথে দু-দিন থামিলাম / ভালোবাসার মালাখানি গলে পরিলাম … কতজনে কত-কী দিলাম / যাইবার কালে একজনারও দেখা না-পাইলাম … হৃদয় দিলে যার হৃদয় মেলে / হৃদয় যাবে সে কাল পথে ফেলে … দেখুন, কী অদ্ভুত! গোলকধাঁধা রে ভাই, তাই লেগেছে তাক — তো, অসুবিধে নেই কিচ্ছু — কপাল মন্দ আজ, কাল চিচিংফাঁক … নিশ্চয়ই, হ্যাঁ, সার্টেইনলি। কিন্তু দুরন্ত দিনের ঘূর্ণিপাকে দেশগেরামের বারুনি-শিবমেলা আজ তো ক্ষয়িষ্ণু, লুপ্ত হবার পথে। এ-প্রসঙ্গে একটু পরে যাই। রিয়্যালিটি এড়িয়ে গেলে লেখা সাক্সেসফ্যুল হয়, সিনেমা-ফোটোগ্রাফিশিল্পও, কবিতার তো রিয়্যালিটি এড়ানোতেই পোয়াবারো; জনপ্রিয় হতে কে না চায় হে! প্রিয়জনহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়! অ্যানিওয়ে, যেটুকু বাঁচিয়া আছে মেলা বা বান্নি, যেটুকু চৈতন্যচত্বর, তা আগে বলে নেয়া যাক।

***

মূল মন্দিরগৃহ সমতল থেকে অনেক উঁচুতে, সেখানে বেয়ে ওঠা আদৌ কষ্টকর কিছু নয় আর, একসময় ছিল যদিও, বয়স্কদিগের জন্য এখনও এবং চিরকালই পাহাড় আরোহণ কিছুটা হ্যাপা তো বটেই। ইদানীং মন্দিরভবনের ঝাঁ-চকচকে জেল্লা হয়েছে, যেমন মসজিদ-গির্জাগুলোতেও দেখবেন, যেন শপিংম্যলের টাইলস দিয়া কাস্টোমার-কেয়ার প্রোভাইড করা। সেই আগের শান্তিশ্রী-স্নিগ্ধাশ্রী নাই। কর্পোরেট কম্যার্শিয়্যাল লেবাস এখন এমনকি অলমাইটিভিলা-হাভেলিতেও। পূণ্যার্থীরা আনন্দিত হইলেই ঈশ্বরজি দিলখুশ রহেন। আলবৎ। মন্দিরচুড়ো থেকে অবরোহণ করে ফের আরেকটা পাহাড় দ্রষ্টব্য। সংলগ্ন, প্রায় যুগল টিলাই বলা চলে। এতদঞ্চলে ভূপ্রাকৃতিক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের একটা হচ্ছে এখানকার উঁচা-উঁচা পাহাড়গুলো আসলে ঠিক পাহাড় নয়, এগুলো টিলা। পাহাড়ের কিউট একটা ভার্শন। বালবৃদ্ধবনিতার আরোহণসামর্থ্যের আওতায় এইসব টিলা দেখে আপনার আকস্মিক মনে হতে পারে যে চর্যাপদের সেই-যে শবরপা-শ্লোকগুলোতে বর্ণিত নগরবাহিরে ডোম্বিনীর কুঠিবিবরণী, সেই জায়গাটা কী এই এলাকাটাই! কিন্তু ক্যামনে কী! ওই এলাকা তো এইদিকে কোথাও বলিয়া আবহমান ইতিহাসযান সাক্ষ্য দেয়নাকো! তো, যা বলছিলাম, ওই নিকটবর্তী তথা মন্দির-লাগোয়া টিলায় উঠে যেয়ে দেখতে পাবেন প্রত্নগৃহ কম্পাউন্ড। ওই ভগ্ননির্জন প্রাসাদচত্বর ঘিরেই ঘূর্ণি দিয়া কাটিয়াছে চৈতন্যশৈশবের একাংশ। ওই রাজবাড়িটাই বৈষ্ণব রসজ্ঞ ও সুরডুবন্ত মহাপ্রভু চৈতন্য দেবের মাতুলালয়, মামাবাড়ি, নেচে-গেয়ে কেঁদে ও কাঁদিয়ে অন্ত্যজ মানুষের মনরাজ্যিপাট জয়ের এই নায়ক এইখানে কাটায়েছেন তার জীবনের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ। আর্কিয়লোজিক্যাল অবহেলা আর হাজার ধান্দার দখলদারি-হিংসা-চুরিচামারি সত্ত্বেও বিল্ডিংটা আজও দর্শনীয়। এর চারপাশের সীমানা-সরহদ্দি, নিসর্গ ও গাছপালা, উঁচু থেকে দেখাদেখির নিচুদেশ, পুরনো তোরণ দিয়া দেয়ালগাত্র ভেদিয়া ভেতরে প্রবেশের পরে একদিকে রাজবাড়ির নিত্যপূজাহ্নিকের ইয়াব্বড় মন্দির, তাতে কঠিন কালো যুগল রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ, মন্দিরঘরের ঠিক বিপরীত দিকে দ্বিতল রাজপ্রাসাদ ভবন, উঠোনের ঠিক মাঝখানে তুলসীমঞ্চ, তুলসীমঞ্চেরও সুরত ঠিক সাধারণদৃষ্ট তুলসীবেদির ন্যায় নয়, একেবারে রাজকীয় তুলসীমঞ্চ, বোঝা যায় এককালে এই মিনারসদৃশ ব্রিকবিল্ট তুলসীমঞ্চটি দ্বিতলছোঁয়াই ছিল, এখন কালের ঝড়ে মুষড়ে-পড়া আধেক চেহারা তার। ভবনকোণে সিঁড়িঘরের অপরিসর চিকন ধাপগুলো ক্ষয়ে যেতে যেতে এখনও বহাল, উঠে যেতে পারেন আপনি দ্বিতীয় তলায় তথা ছাদে, ছাদটি কাঁটানটে আর ঝোপবেষ্টিত, কামরাগুলোর বিভাজক দেয়ালগুলো পলেস্তারার নিশানা আজও বহন করছে, খুব নিরিখ করে দেখলে এইসব টের পাবেন আপনি। কিন্তু এমনিতে খালি চোখে দেখবেন অশ্বত্থলতাগুলো ভবনটাকে যেন গ্রাস করে ফেলেছে। সেই কবেকার কোন ধূসর অতীতের বটগাছবেষ্টনী, কিন্তু তবু বিল্ডিং টিকে আছে, টিকিয়া থাকবেও, শুধু মানুষের নাগপাশে গেলেই বিল্ডিঙের বারোটা বাজে, যেমন বারোটা বাজে গাছের ও বাঘসিংহসর্পের, বারোটা বাজে সারসের। প্রকৃত সারসের কথা তো বলাই বাহুল্য, অথবা বিনয় মজুমদার রেফার করা যায় এ-প্রসঙ্গে। অ্যানিওয়ে। কম্পাউন্ডের চারপাশে নৈসর্গিক প্রশান্তি, তপোবনের আবহ, প্রাচীন পুরাণকথার গন্ধ লেগে আছে যেন তার চারিপাশে। একপায়ে খাড়া তালগাছ, বেলগাছ প্রচুর, কাঁঠালগাছ অসংখ্য, জঙ্গুলে কাঠগাছ, গুলাচফুলের মোটা মোটা মহীরূহপ্রতিম গাছ, প্রচুর গুল্মরাজির ভেতর টগরফুল ফুটন্ত নক্ষত্রের ন্যায়।

untitled-3-***

জুয়া আর হাউজি ছাড়া মেলা কি কল্পনা করা যায়? যদি থাকে কোথাও জুয়া ছাড়া মেলা, তাহলে সেইটা আদৌ অরিজিন্যাল মাল নয়, ফেইক মেলা, ধার্মিক ও নিয়ন্ত্রিত, যেমন কালো দাগটা ছাড়া চাঁদ। জুয়া আর হাউজিরও কত রকমফের্কা, স্থানীয় অনেক ইনোভেটিভ জুয়া-হাউজি ফি-বছর যুক্ত হয় মেলার সঙ্গে, সেসবের বেশিরভাগই নির্দোষপ্রায়, এবং স্বল্পমাত্রার পকেটস্বাস্থ্যহানিকর। বান্নিতেও দেখবেন যে ওই দূরে ডানে একটা হলে বাঁয়ে তিনটা কালো-কালো চুলওয়ালা মাথার জটলা। আপনি টিলার সুদূর নিরাপদে বসে দেখে যেতে পারেন হাউজিওয়ালা জুয়াড়ি নিয়তিনিরীহ মানুষদঙ্গলের সতর্ক ফুর্তি, চাইলে যেয়ে দুইদান শরিকও হতে পারেন, লাক ট্রাই, অকস্মাৎ জটলার ভেতর হুড়োহুড়ি, মুহূর্তে ছত্রভঙ্গ জটলা, দিগ্বিদিক ছোটাছুটি, কে যেন বলেছে পুলিশ আসছে রে! একটু চোখ ফিরিয়ে ফের এদিকে তাকালে দেখবেন পুনরায় শুনবেন ‘উত্তমকুমার-সুচিত্রাসেন, নাম্বার টেন’ … জমে ফের ক্ষীর জুয়া-হাউজিবীর! এইসব বান্নিরই পার্ট।

***

ঠাকুরের পুকুর এক-সময় যে-আয়তনের ছিল, এখন তার অর্ধেকেরও কম। আমি নিজে দেখেছি এই পুকুর ঘিরে মেলার যে মহা আয়োজন, তার অর্ধেকেরও কম এখনকার অবয়ব। তবু আপনি যদি আগের রূপ না-দেখা লোক হন, মনে হবে এরচেয়ে বিগ গ্যাদারিং দুনিয়ায় থাকলেও বাংলায় নাই। কিন্তু আছে। এই সিলেটেই সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত সীমান্তে আছে পনাতীর্থের বান্নি। আছে সেই পনাতীর্থের বারুনিস্নানকেন্দ্রিক ব্যাপক জমায়েত ও মেলা। সেখানকার ফিচার আবার আরেকটু ইউনিক। শারপিং শা-র মাজার আর বারুনিস্নানস্থল অলমোস্ট একই জায়গা, আর স্নান ও উরস একইসঙ্গে পড়ে। সে-সঙ্গে ইন্ডিয়ার বর্ডারও অবমুক্ত করে দেয়া হয় অঘোষিতভাবে। আমরা এস্পার-ওস্পার হতে পারি তিনদিন মুফতে। সেইটা আরেক কাহিনি। রিপোর্টাজের কন্টেক্সট এইটা না, পনাতীর্থ অন্যদিনের প্রতিবেদনের জন্য তোলা থাক। যা বলছিলাম, বেদখল হয়ে যাচ্ছে মেলার বিশাল প্রাঙ্গন। ঠাকুরের পুকুর ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো অলরেডি বাণিজ্যিক ভবনদালানের দখলে। বেহাত হয়ে গেছে টিলার নিম্নভূমির বৃহদাংশই। চৈতন্যস্মৃতিধামে একদম প্রবেশমুখে একটা মসজিদ উঠেছে বছর-কয়েক হলো, বহরে-গতরে সেইটা বাড়ছে দিন-কে-দিন। সম্প্রীতি বিকশিত হোক। আশপাশ জুড়ে শেখ-সুফিদিগের হাভেলি-ভিলা আলিশান না-হলেও দেয়াল তুলিয়া আনন্দেই বহাল তবিয়ত লক্ষ করবেন। বেহাত হয়ে যাওয়া খারাপ কিছু না, ধার্মিকদিগের সম্প্রীতি আর কোলাবোরেশন ব্যাহত না-হইলেই হইল। এইসব বিষয়ে ইনভেস্টিগেইট করা ভদ্রলোকের লক্ষণচিহ্ন নয়। এবং পেটে পাত্থর বেন্ধে থাকুন লজ্জা নাই, নিরন্ন-নিরম্বু মরিয়া যাউন অসুবিধা নাই, কিন্তু ভদ্রলোকের লিস্টি থেকে একবার নাম কাটা গেলে সমাজে মুখ দেখাবেন কী উপায়ে! এইসব কথাবার্তা বান্নির অংশ নয়, যদি ইনসিস্ট করেন জানতে, মেলা থাকুক তবুও শত কূটচাল-কুচক্র সয়েও। মেলা নাই তো মানুষ দিয়া আমড়া হবে? ভাইস-ভার্সা, মানুষ যদি হারায়ে যায় তাহলে মেলা আসবে কোত্থেকে? ঐশী দিগ্বলয়পূর্ণ জ্যোতিধাম থেকে?

চৈত্রে গৃহীত বান্নি চিত্রাবলি ১৪২১ ভিডিও দেখার জন্য লিঙ্ক…

img_5863 img_5868 img_5869 img_5874 img_5881 img_5882 img_5886 img_5891 img_5900 img_5903 img_5920 img_5953 img_5967 img_5970 img_5975 img_6000 img_6011 img_6016 img_6020 img_6029 img_6033 img_6039 img_6046 img_6051 img_6054

img_5950https://www.facebook.com/video.php?v=10204907173891348&ref=notif&notif_t=like                                                                                                                      _________ # #

জাহেদ আহমদ

অনিয়মিতভাবে লেখালেখিলিপ্ত, মূলত নোটক, মুখ্যত প্রকাশবাহন ফেসবুক

লেখকের অন্যান্য পোস্ট

লেখকের সোশাল লিংকস:
Facebook

Tags: , , , , , , ,

লেখকের অন্যান্য পোস্ট :

সাম্প্রতিক পোষ্ট