সাম্প্রতিক

ফ্রিটাউনের ক্যাফে থেকে ধারাভাষ্য । মঈনুস সুলতান

বিকল্প প্রস্তাব

বিবেচনা করো আমার এ বিকল্প প্রস্তাব —
বালিশের পাশে রাখো সাতটি তারার তিমির,
অবচেতনের সরোবরে পড়ে ধুমকেতুর প্রভাব
কাবালা পুরাণ হাতে নিয়ে — পড়ো কিছু হিব্রু কিতাব।

চিত্রকর নও তুমি তবু হাতে তুলে নাও রঙতুলি
আঁকো করোটির কোটরহীন চোখে উপগ্রহের প্রতিমা,
রিক্সায় চড়ে যাচ্ছে দ্যাখো তেঁতুলগাছের ছায়া
অতিক্রম করে যাও সৃজনের সহিষ্ণু সীমা।
নেমে যাও রেলগাড়ি থেকে নিশুতি রাতে অজানা ইশটিশনে —
তাকাও সিগন্যালের লোহিত সবুজ আলোয় পুরানো পুঁথির পাতায়,
প্ল্যাটফর্মে চশমা চোখে তিন দেবদূত তেপ্পান্নটি তাস সাজায়
দাঁড়িয়ে দেখো — টিকিটঘরের আন্ধারে তাদের বস্তুরঙ্গ সঙ্গোপনে।

মানবজন্ম মোক্ষ কিছু নয় — চাইলে হতে পারো তুমি
গাঙ্গেয় অববাহিকায় গৌরবময় গাঙচিল,
হাঁটো ছায়াপথে — কসমিক স্লোগ্যানে মাতাও নক্ষত্রের মিছিল।

আধফোটা ছবি

জাগে আবছা অবয়ব
ডার্করুমে আধফোটা ছবি — দেখি না আননবিভা
জানি না কেন তবু তৈরি হয় তূরীয় অনুভব!

দনকলসের পাপড়ি-ছাওয়া আঙিনায়
দেখি জানালার ইশারা,
সরোবরে ডোবা সপ্তর্ষির বোঁটা থেকে
শিউলি ঝরায় সাতটি তারা,
ফোটে না জলরঙের সম্পূর্ণ দৃশ্যপট;
তৈরি  হয় মঞ্চ এক মননের নিভৃতে
দেখি না তাতে দোতারা হাতে বাউলা নট।

কাঁটালতা ক্যাকটাসে মৃত্তিকা হয় গোলাপি
কার নিরাসক্ত কাননে কেন আমি রাত্রি যাপি?
কুরে খায় অজীর্ণ স্মৃতি — বহুদিনের ব্যবহৃত বর্ণ
মুছে যায় শুভ্রতা, পারি না বলতে সামান্য এ কথা ।

এসো, ফ্রিটাউনের ক্যাফে সাফরানে

ভালো হয়েছে, এসেছো আজ গল্ফ ক্লাবে
বসেছো কার্ডটেবিলে পরদেশী তিন যুবকের সাথে
বলছো কথা মৃদু স্বরে শোভন সদভাবে;

কালকেও দেখেছি তোমাকে
মামবা পয়েন্টে পানশালায়,
বসে ছিলে ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর পাশে একা
ঘুরেফিরে ফ্রিটাউনের হরেক চবুতরায়
নানা মাইফেলে বারবার
আমাদের হয়ে যাচ্ছে দেখা;

মোমের আলোয় অদৃষ্ট ছুঁয়ে কাল বেজায় বিষণ্ণ ছিলে
বার-কাউন্টার থেকে যখন ড্রিংক্স নিলে,
মৃদু হেঁটে মৎস্যকন্যার লাস্যে
কটিতটে দোলনচাপার ছন্দমাধুরী রটে
চোখে চোখে অভাজনের ধারাভাষ্যে;

আজকে সাবলীল ক্লাবখানায়
নৃত্যের মেহগিনি পাটাতনে,
দেহে তোমার বক্ররেখা নিসর্গের খেয়ালে
আঙিনায় ঋষিবৃক্ষের পাতা কাঁপে আনমনে
বাটিকের চিত্রিত বনে আদিম গুহার দেয়ালে,
আঁকা গুল্মময় ত্রিভুজ
সারাসিনের স্থাপত্যবিশেষ
বুকে ধরে রাখো কম্পমান জোড়া গুম্ভুজ;

এসো, কথা বলি
কিনে দেই কাটগ্লাসে টলটলে ককটেল
এভাবে হয় জেনো, মাছের ছায়া দেখে
সৈকতে শুভ্র সিগাল উদ্বেল;

কাছে এসো, বাইরে যাই
সিগ্ধ আঙিনাতে ঋষিবৃক্ষের রূপালি ছায়ায়
একটু দাঁড়াই,
দ্যাখো — ঘাসের সবুজ ধনেখালিতে
পপকর্নের মতো ঝরছে জেসমিন,
তুমি ভালোবাসো ধ্বনি
পাঁজরের আইপডে মৃদুস্বরে শোনো
হৃদয়ের তাধিন;

রূপোজীবা নও তুমি
না-আঁকা চিত্রপটের বিমূর্ত ভাবনায় বিভোর ভার্জিন,
ওভাবে চাইনি তো তোমাকে
শুধু পরশের পাপড়িতে বিভোর হয়েছি
অচল মুদ্রার মতো বহুব্যবহারে আমি অর্বাচীন;

ঠোঁটে ধরে আছো যে-সিক্ততা
তিতমধুর সুরভিতে ভরা ভারমুথ,
গ্রীবার আকাশনীলে কীভাবে যেন
আঁকা হয়ে যায়
মহুয়ার মোহরের ছাপ নিখুঁত;

কালকে আবার এসো
সমুদ্রপাড়ে ক্যাফে সাফরানে বসি আমি
দুপুরবেলা প্রতিনিয়ত,
সৈকতসূর্যের নিরিবিলিতে পান করো
এক পেয়ালা মাকিয়াতো,
জানা যাবে আগ্রহ তোমার প্রণয় না পারফিউমে
আমি আছি প্রাচীন মুদ্রা মানচিত্র
আর অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপির ভলিয়্যুমে;

আসবে কিন্তু
জানো তো ফ্রিটাউনে উড়ছে আজকাল অজস্র বাদুড়
তাদের কালো ডানায় ছড়াচ্ছে কলঙ্কিনী ইবোলা,
বলা তো যায় না কখন কীভাবে রদ হয়ে যায়
আমাদের পথচলা।

জামদানীর নকশায় জড়ানো বোধ

হাঁটুতে চাক বেঁধেছে বিষপিঁপড়া
পারছি না দাঁড়াতে একেবারে —
নিষ্ফলা সকাল সন্ধ্যা দুপুর
বাড়িয়ে দিলে চন্দনকাঠের ক্র্যাচ,
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দ্যাখো চলে এসেছি কতদূর —
ধানখেতের চৌচালা দহলিজ পেরিয়ে মাউন্ট মিরাপি
গায়ে লাগে আগুনপাহাড়ের আঁচ।

কাছেই জলের চাষবাস — ঊর্মির নিধুয়া পাথার
হলোই-বা পলকা কায়াক,
ধরিয়ে দিলে জামদানী নকশায় জড়ানো বৈঠা
রূপার হাল —
প্রস্তুতি নেই নৌভ্রমণের
যে যাত্রার ঠিকুজিতে লেখা শুধু আগামীকাল।

নাও বেয়ে পেরিয়ে এসেছি জলের সবুজ বিস্তার
রূপালি বাষ্পে ঝুরে সূর্যের বেগুনি রশ্মি
আলোজলের সেতার,
ধ্বনি-চুমকিতে রূপ খেলে বাহামা
বারমুডার রহস্যময় ত্রিভুজ,
প্রবালের বাগিচায় সাজানো দেখি
ঝিনুকের ঝলমলে ভোজ।

হাঁটু আর ভালো হলো কই — তারপরও হাঁটতে হাঁটতে
বৃষ্টিবনে — অল্পদূরে মাউন্ট কিলিমানজারো,
ক্লাইম্বিং গিয়ার পরে হাইক করা যায় কি?
তুষার ঝরছে শিখরে —
ভেতর থেকে কে যেন বলে — তুমিও পারো।

অতিক্রম করে পোড়ামাটির গ্রাম গমের সাতমহলা
দেবদারুর ঘরদুয়ার,
সুরত লালের মর্গ … পরবর্তী পৃথিবীর দিকে —
ওখানে বেহেস্তের গরুবাছুর
ফেরেশতাদের সমবেত খামার,
হাঁটুতে জড়িয়ে ব্যথা নিবারনী আয়ূধ
প্রার্থনা করি কম্পাস,
ক্র্যাচ তো দিলে, বৈঠাও
পারো নাকি দিতে
জামদানীর নকশায় উদ্ভাসিত জ্বালাময় বোধ।।

মঈনুস সুলতান

ভ্রমণগল্প লিখে বাংলাদেশের পাঠকসমাজে ব্যাপক সমাদৃত মঈনুস সুলতান মূলত কবি । দীর্ঘদিন কবিতা পাকাশিত হয়নি যদিও, সম্প্রতি হয়েছেন ফের কবিতায় প্রত্যাবর্তিত । ভুবন ভ্রমিয়া ফেরেন তিনি কতকটা পেশাগত প্রয়োজনে, এবং অনেকটাই প্যাশন থেকে । লেখেন উপন্যাসোপন গদ্যপ্রকৌশলে সেইসব বৈচিত্র্যমুখর দেখাদেখির বৃত্তান্ত । সৈয়দ মুজতবা আলীর পরে সামাগ্রিক বিচারে বাংলা সাহিত্যে বৈঠকী স্বাদুতাবাহী গদ্যের পরম্পরা নবতর বৈদগ্ধ্যে-বৈভবে মঈনুস সুলতানের ন্যারেটিভে পাওয়া যায় । লেখকের জন্মজেলা সিলেট । স্ত্রী ও একমাত্র আত্মজা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও খণ্ডকালীন অন্যান্য নানা দেশে বাস করেন । প্রকাশিত বই প্রায় দশেরও অধিক, সব-কয়টিই পাঠকাদৃত, গদ্যগুণবিচারী পাঠকই তাঁর গ্রন্থগ্রাহী । কয়েকটি বই : ‘নিকারাগুয়া সামোটা ক্যানিয়নে গাবরিয়েলা’, ‘জিম্বাবুয়ে বোবা পাথর সালানিনি’, ‘মৃত সৈনিকের জুতার নকশা’, ‘কাবুলের ক্যারাভান সরাই’ প্রভৃতি । পেয়েছেন মননশীল বিইশাখায় ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কার ১৪১৯’।

লেখকের অন্যান্য পোস্ট

লেখকের সোশাল লিংকস:
Facebook

Tags: , , , ,

লেখকের অন্যান্য পোস্ট :

সাম্প্রতিক পোষ্ট