সাম্প্রতিক

মনিপুরী নৃত্য আর লোকজ সুরের শীতসন্ধ্যা

মাহি রহমান : আদিগন্ত কুয়াশাঝাঁপানো পৌষসন্ধ্যার কনকনে হিমের ভিতরেই সিলেটে একটি নৃত্যগীতের আসর অনুষ্ঠিত হয়ে গেল শ্রোতা-দর্শক সমুজদারদের সমবেত স্বতঃস্ফূর্ততায়। শীত ছিল সহনীয় মাত্রা ছাড়ানো, তবু দর্শকশ্রোতার সমাগম ছিল প্রেক্ষাকক্ষ উপচানো। বছরের শেষ হপ্তায়, ২৬ নভেম্বর শনিবার সন্ধ্যায়, নৃত্যগীতের মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানটি সিলেটের চা-বাগানপরিবেষ্টিত খাদিমনগর এলাকায় এফআইভিডিবি মিলনায়তন মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়।

অ্যাকাডেমি ফর মনিপুরী কালচার অ্যান্ড আর্টস্ পরিবেশিত নৃত্যকর্মের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা আবহমান সুরের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিদর্শন শুনিয়ে শ্রোতাদের মন্ত্রাবিষ্ট করে রাখেন শিল্পী প্রসূন রায় এবং শ্যামলী বসাক। উভয়ের পৃথক পরিবেশনায় একে একে হাজির হয় বাংলার দিকপাল পদকার সংগীতস্রষ্টার একগোছা গান। বিশেষভাবেই শিল্পী প্রসূন রায়ের কণ্ঠে যথাক্রমে শচিন দেব বর্মণ এবং শাহ আবদুল করিমের গান শ্রোতাদের তারিফ কুড়িয়েছে। একইসঙ্গে শ্যামলী বসাকের লোকসংগীতোপযোগী বিশেষত্ববহ গলায় রাধারমণ দত্তের সুরগুচ্ছ মূর্ছনাধারায় তীব্র করে তোলে শিশিরফোয়ারা। উভয় শিল্পীর সঙ্গেই অ্যাক্যুস্টিক্ বাদ্যযোজনা গানের প্রায়োগিক আবেদন উঁচুতারে বেঁধেছিল সন্ধ্যায়োজনটিকে। বাদ্যযন্ত্রে গোটা আয়োজনটিকে তালবন্ধনে রেখেছিলেন তবলাশিল্পী অয়ন চক্রবর্তী এবং ঢোলকশিল্পী পিয়ম বসাক। পরিবেশনাকালীন শিল্পীরা হারমোনিয়াম নিজেরা বাজিয়েছেন পরিমিত শিল্পসৌকর্য বজায় রেখে।

IMG_4087

আলোকচিত্রী : দীপক রায়

সান্ত্বনা দেবী পরিচালিত নৃত্যায়োজনে একাধিক খণ্ডে একগুচ্ছ মনিপুরী নৃত্যকলা নান্দনিকতায় নৃত্য-উপভোক্তাদের নজর মোহিত করে রেখেছিল। উল্লেখযোগ্য নৃত্যরচনাগুলোর মধ্যে একটি ছিল ‘মাইবি’, নৃত্যশাস্ত্র অনুসারে মাইবি হচ্ছে পূজারীদের নাচ তথা নাচের মধ্য দিয়ে দেবতাকে নিবেদিত অর্ঘ্য, নৃত্যনৈবেদ্যের মাধ্যমে দেবতাতুষ্টি অর্জন এই নৃত্যের অভীষ্ট। ‘দশাবতার’ শীর্ষক অন্য একটি নৃত্যরচনায় বিমোহিত দর্শকপ্রতিক্রিয়ায় অ্যাকাডেমি ফর মনিপুরী কালচার অ্যান্ড আর্টস্ শিল্পালয়ের নৃত্যশিল্পীদের কুশলতা সপ্রশংস করতালি লাভ করে। মনিপুরী নৃত্যসাহিত্যের বয়ানে এই নৃত্যখণ্ডটিও ভক্তিরসের অবলম্বনে একটি বীরবন্দনামূলক দুর্গতিনাশন বরাভয়ের কলাকাজ। যখনই প্রথাগত ধর্মের মোড়কে গ্লানি ও হানাহানির কূটিলতায় আবিল হয়ে যায় পৃথিবীর মর্ত্যভাগ, স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু তখন মর্ত্যভুবনের কল্যাণে এবং সজ্জনসাধু সর্বজনের রক্ষার্থে এই বিভেদরক্তার্ত ধরণীতে একলাই দশ অবতারের রূপ ধরে অবতীর্ণ হন। ‘দশাবতার’ শিরোনামক অনবদ্য কম্পোজিশনে এই দৃশ্যকোলাজটিকেই নৃত্যমুদ্রায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই সন্ধ্যার আরেকটি বিশেষ উপভোগ্য নৃত্যকাজ ছিল ‘মন্দিরা নৃত্য’। অত্যন্ত রোম্যান্টিক মেজাজের আঙ্গিক এই নৃত্যের গ্রথনে এনেছিল ফুরফুরে এক ফল্গুধারার আমেজ। এটি আদতে একটি উৎসবনৃত্য। ঝুলন উৎসবের সময়ে রাধা-কৃষ্ণ যুগলকে দোলনায় নিয়ে গোপীরা মন্দিরা বাজিয়ে এই নৃত্য করে থাকেন। ব্যুৎপত্তিবিচারে এইটুকু পরিচয় মাত্র নয়, মনিপুরী নৃত্যের শৈলীশোভা চাক্ষুষ করার ব্যাপার, বর্ণনায় এর বিভা অল্পই বিবৃত করা যায়।

উল্লেখ্য যে, সিলেটের আবহমান সংস্কৃতিতে ক্রমে ঐতিহ্যেরই অংশ হয়ে উঠেছে এই শিল্পঋদ্ধ অনন্যমাত্রিক মনিপুরী নৃত্য। অ্যাকাডেমি ফর মনিপুরী কালচার অ্যান্ড আর্টস্ এই নৃত্যানুশীলনে এবং এর প্রসারে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে। ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও রচিত নৃত্যমালা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও প্রশংসিত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান সঞ্চালক এবং কোরিয়োগ্রাফার সান্ত্বনা দেবী এফআইভিডিবি আয়োজিত অনুষ্ঠানের নৃত্যসম্ভার মঞ্চায়ন করেন। নৃত্যের বিভিন্ন রচনায় শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন চৈতী, সন্দ্বীপা, জুটিকা, পিংকী প্রমুখ।

মাহি রহমান

রাশপ্রিন্ট কন্ট্রিবিউটর

লেখকের অন্যান্য পোস্ট

Tags: 

লেখকের অন্যান্য পোস্ট :

সাম্প্রতিক পোষ্ট