
বেলারুশিয়ান অনুসন্ধানী সাংবাদিক, পাখিবিশারদ ও আখ্যান রচয়িতা সভেতলানা আলেক্সান্দ্রভনা আলেক্সিয়েভিচ এ বছর সাহিত্যে ‘নোবেল পুরস্কার ২০১৫’ লাভ করেছেন। নোবেল কমিটির ভাষায়, ‘তিনি এই পুরস্কার অর্জন করেছেন তার বহুস্বরিক লেখালেখির জন্য। তিনি ছিলেন আমাদের সময়ের দুর্ভোগ ও সাহসের এক সৌধ’। সভেতলানা বেলারুশের একমাত্র লেখক যিনি প্রথমবারের মত সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ এই পুরস্কার পেলেন।
১৯৪৮ সালের ৩১শে মে ইউক্রেনের স্তানিস্লাভ শহরে বেলারুশিয়ান বাবা ও ইউক্রেনীয় মায়ের ঘরে জন্মগ্রহন করেন এই লেখক। বেলারুশে তিনি বেড়ে উঠেন। স্কুল শেষ করে স্থানীয় বিভিন্ন সংবাদপত্রে রিপোর্টারের কাজ করেন। তারপর তিনি ‘নেম্যান ইন মিনস্ক’ নামক সাহিত্য ম্যাগাজিনের করেস্পন্ডেন্ট হিসেবেও কাজ করেন। তিনি রুশ ভাষায় লেখালেখি করতেন।
তিনি সাংবাদিকতা এবং দেশের অত্যন্ত বিয়োগান্তক ঘটনাসমুহের প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাতকার গ্রহনের ভিত্তিতে আখ্যান রচনা করে লেখালেখির ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। এসবের মধ্যে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং চেরনোবিল বিপর্যয়।
১৯৭০ সালের দিকে তিনি যখন স্থানীয় পত্রিকাতে রিপোর্টারের কাজ করতেন, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া নারী সৈন্যদের স্মৃতিচারণা টেপ রেকর্ডিং করে রাখতেন। তার এই কাজের ফলাফল ছিল প্রথম উপন্যাস ‘ওয়ার্স আনওমেনলি ফেস’। এতে সমাজতান্ত্রিক পার্টির ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ না করা এবং ব্যাক্তির পার্সোনাল ট্রাজেডির আলোকপাত করার কারনে বইটি প্রকাশের ওপর দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। অবশেষে ১৯৮৫ সালে পেরেস্ত্রোইকার সংস্কারের সময় বইটি প্রকাশিত হয়।
আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো সরকারের উৎপীড়ন ও নিগ্রহের পর ২০০০ সালে তিনি বেলারুশ ছেড়ে যান। ইন্টারন্যাশনাল সিটিজ অফ রিফিউজি নেটওয়ার্ক তাকে রাজনৈতিক শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় প্রদান করে। পরবর্তী এক দশক তিনি প্যারিস, গুটেনবার্গ এবং বার্লিনে বসবাস করেন। ২০১১ সালে সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ মিনস্কে ফিরে আসেন।
তার লেখা বই সোভিয়েত এবং সোভিয়েত উত্তর ব্যাক্তির আবেগময় ইতিহাসের সাহিত্যিক কালানুক্রম ব্যাখ্যা করে থাকে; যা বর্ণিত হয়েছে নিষ্ঠার সাথে নির্মিত- গৃহীত সাক্ষাতকার সমুহের কোলাজের তাৎপর্যের দ্বারা। লেখক দিমিত্রি বাইকভের মতে, তার বইগুলো বেলারুশিয়ান লেখক এলেস এডামোভিচ এর আইডিয়ার কাছে অনেক ঋণী। যিনি দৃঢ়তার সাথে বলতেন, বিংশ শতাব্দীর হরর বর্ণনা করার একমাত্র পথ শুধু ফিকশনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়নি। সাক্ষীদের সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তা হয়েছে। বেলারুশিয়ান কবি উলাদজিমির নায়াক্লভ এডামোভিচকে সম্বোধন করেন, ‘হার লিটারারি গডফাদার’ বা সাহিত্যের মহান ধর্মপিতা হিসেবে। তিনি এডামোভিচের দালিলিক উপন্যাস ‘আই এম ফ্রম দ্যা বার্ন ভিলেজ’ এর নামও উল্লেখ করেন যা বেলারুশ দখলের সময় নাৎসি বাহিনির হাতে পুড়ে যাওয়া গ্রামগুলোর ওপর লেখা একক ও প্রধান উপন্যাস। সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচের দৃষ্টিভঙ্গিকে যা সাহিত্য রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। সভেতলানা নিজের লেখায় এডামোভিচের প্রভাব স্বীকার করে বলেন, অন্যান্য আরো অনেকের মধ্যে বেলারুশিয়ান লেখক ভাসিল বাইকাও হলেন অন্যতম একজন, তার লেখালেখিতে যার প্রভাব রয়েছে।
ইংরেজি ভাষায় অনূদিত তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে ‘জিঙ্কি বয়েজ’, সরেজমিনে আফগান যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে রচিত এই উপন্যাস। এবং চেরনোবিল বিপর্যয়ের এক উচ্চ প্রশংসিত বাচনিক ইতিহাস হল ‘ভয়েসেস ফ্রম চেরনোবিল’।তিনি তার কাজের বিষয়বস্তু সম্পর্কে এভাবে ব্যাখ্যা প্রদান করেনঃ
যদি আপনি আমাদের সমগ্র ইতিহাসের দিকে তাকান, সোভিয়েত এবং সোভিয়েত উত্তর উভয়ের দিকে, দেখতে পাবেন, এটা বিশাল এক সার্বজনীন সমাধিক্ষেত্র আর রক্ত-স্নানের ইতিহাস। জল্লাদ আর উপদ্রুতের এক শাশ্বত কথোপকথন। অভিশপ্ত রাশিয়ানদের প্রশ্নঃ কি করা র আছে এখন আর কে দায়ী হবে এসবের জন্য? বিপ্লব, বাধ্যতামুলক শ্রমশিবির, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, জনগণের কাছে আড়াল করা সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ, বিশাল এক সাম্রাজ্যের পতন, দানবীয় সমাজতান্ত্রিক ভুমির পতন, কল্পলোকের এক রাজ্য, এবং এখন মহাজাগতিক মাত্রার চ্যালেঞ্জ- চেরনোবিল। পৃথিবীতে জীবন্ত সব কিছুর জন্য এটা এক চ্যালেঞ্জ। এই আমাদের ইতিহাস। এবং এটাই আমার বইয়ের বিষয়বস্তু, এটাই আমার পথ, আমার নরকের পরিধি, মানুষের থেকে মানুষে।
লেখকের প্রথম বই ‘ওয়ার্স আনওমেনলি ফেস’ ১৯৮৫ সালে বের হওয়ার পর অসংখবার পুনর্মুদ্রিত হয়েছে এবং দুই মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। এই উপন্যাস নির্মিত হয়েছে ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতে নারীর মনোলোগের ওপর যা পূর্বে কখনোই আলোচিত হয়নি। তার আরেকটি বই হল, ‘দ্যা লাস্ট উইটনেসঃ বুক অফ আন চাইল্ডলাইক স্টোরিজ’। যুদ্ধকালীন শিশুদের ব্যক্তিগত স্মৃতিকে বর্ণনা করে এমন এক বই। তার লেখায় নারী এবং শিশুর চোখে যুদ্ধকে দেখানো হয়েছে, যেখানে প্রতিভাত হয়েছে অনুভবের এক নতুন জগত। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘এনচেনটেড উইথ ডেথ’। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারনে সে সময়কার প্রকৃত এবং আত্মহত্যার চেষ্টারত মানুষের সম্পর্কে এই বই। অসংখ মানুষ কমিউনিস্ট ভাবাদর্শ থেকে নিজেদেরকে অবিচ্ছেদ্য মনে করেছিল আর নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা ইতিহাস এবং শাসন মেনে নিতে তারা অসমর্থ ছিল।
১৯৯৩ সালের পর তার কোনো বই বেলারুশের রাষ্ট্রীয় প্রকাশনা সংস্থা থেকে বের হয়নি। পরবর্তীতে বেলারুশের বেসরকারি প্রকাশনা থেকে মাত্র ২টি বই বের হয়। এর একটি হল ‘ভয়েসেস ফ্রম চেরনোবিল’। প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে। অন্যটি হল ‘সেকেন্ড হ্যান্ড টাইম’। প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। দুটোই বের হয় বেলারুশিয়ান অনুবাদে।
তার প্রধান উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে, ওয়ার্স আন ওমেনলি ফেস। দ্যা লাস্ট উইটনেসঃ বুক অফ আন চাইল্ডলাইক স্টোরিজ। জিঙ্কি বয়েজ। ভয়েসেস ফ্রম চেরনোবিল। এনচেনটেড উইথ ডেথ ও সেকেন্ড হ্যান্ড টাইম।

ভালবাসার গল্পের ওপর লেখা বই ‘দ্যা ওয়ান্ডারফুল ডিয়ার অফ দ্যা ইটারনাল হান্ট’ অতি সম্প্রতি তিনি শেষ করেছেন। এই বইয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রজন্মের নারী ও পুরুষেরা তাদের ব্যাক্তিগত গল্প বর্ণনা করে। “ আমার মনে হয়েছে যে, আমি বই লিখেছি মানুষ কিভবে একে অন্যকে হত্যা করে, কিভাবে তারা মারা যায়, এই বিষয়ে। কিন্তু এটাই সমগ্র মানব জীবন নয়। এখন আমি বই লিখছি মানুষ কিভাবে একে অন্যকে ভালবাসে এই বিষয়ের ওপর। এবং পুনরায় আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি, প্রেমের গোধূলি জুড়ে এই সময়ে— আমরা কে? আর কোন দেশেই বা আমরা বাস করি? পৃথিবীতে যা আমাদেরকে নিয়ে এসেছে, তাই ভালবাসা। আমি মানুষকে ভালবাসতে চাই। মানুষকে ভালবাসা ক্রমবর্ধমান ভাবে কঠিন হওয়া সত্বেও। এবং তা কঠিনতর হচ্ছে।”
সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ নোবেল পুরস্কার ছাড়া এ পর্যন্ত যেসব আন্তর্জাতিক এওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছেন। তার কিছু হল—
১৯৯৬— তুশলস্কি-প্রেইস (সুইডেন পেন) পুরস্কার।
১৯৯৭— আন্দ্রেই সিন্যাভস্কি প্রাইজ।
১৯৯৮— লিপজিগার বুক প্রাইজ অন ইউরোপিয়ান আন্ডারস্ট্যান্ডিং।
১৯৯৮— ফ্রেড্রিখ-এবার্ট-স্টিফটাং-প্রেইস
১৯৯৯— হারডার প্রাইজ
২০০৫— ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেল এওয়ার্ড, (ভয়েসেস ফ্রম চেরনোবিল)
২০০৭— অক্সফাম নভিব/পেন এওয়ার্ড
২০১১— রাইসজার্ড কাপুশিন্সকি এওয়ার্ড ফর লিটারারি রিপোরটেজ (পোলিশ)
২০১৩— পিস প্রাইজ অফ দ্যা জার্মান বুক ট্রেড।
২০১৩— প্রিক্স মেডিসিস এস্যাই।
এবং দ্যা ইন্ডিপেন্ডেন্ট রাশিয়ান প্রাইজ “ট্রিয়াম্ফ”
উইকিপিডিয়া , দ্যা হিন্দুস্তান টাইমস এবং লেখকের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট অবলম্বনে।