সাম্প্রতিক

‘নাভি ও নন্দন’ থেকে ৫টি কবিতা । ফেরদৌস নাহার

মাঠ ডাকে

যে মাঠে বাতাস ছিল বেগানা, সূর্যের দিন শেষ হল বলে ঘনিয়ে আসে আঁধার
মনে রেখো হে পাতাল সায়াহ্ন, ঘাটে ঘাটে আঘাতের কুড়িটি বছর। তোমাদের
তল্লাটের চেয়েও দামি বাদামি মাটির সন্ধানে কেটে গেছে উড়ন্ত জীবন

ভুলে যেও না, যে বাদ্যযন্ত্রী এখনো বাজায় সুরের কারসাজি, তার হাতে বেঁচে
ওঠে তীব্র স্রোতস্বী বিপুল জল-নহবৎ, শঙ্খের উতলা প্রহর। মাঠ ডাকে, মেঠুয়া
বাঁশি তুই ভুলে যা রে দুশো কোটি বছরের ছুটে যাওয়া আলোকবর্ষের গতি
স্মৃতি এবং স্তুতি

ভ্যান গগের জ্বর

ভ্যান গগ বসেছিলেন এইখানে, জলের দরজা খুলে, সৈকতে পোশাক রেখে
নেমেছিলেন জলে, সেই থেকে জলের ছবিগুলো বড় বেশি নীল মনে হয়
তারপরও সূর্যমুখীর মুখ কেন এত হলুদ লাগছে বলো তো

ভিনসেন্ট পুড়েছে জ্বরে, তার চোখে সূর্যের আলো। কপালে জলপট্টি দিয়ে
সারারাত বসে আছি পাশে, আহারে কেন তার এত জ্বর এল! কেন বোঝে না
সূর্যমুখী সে যে ব্যথার গহন তাপে কেঁপে কেঁপে ওঠে, ঝরে পড়ে আল্পসের বনে

সারারাত ভুল বকে ভোরবেলা ঘুমিয়েছে সে, ডেকো না তাকে। রঙের স্বপ্নমাখা
কোনো স্বপ্ন দেখছে হয়তো, ঘুমঘোরে জ্বর এঁকে যাচ্ছে। তার নিশ্বাসের শব্দ
খুব অন্যরকমের অচেনা লাগছে। এবার থিউকে লিখে দিলাম একবার আসতে

যাবতীয় স্যাক্সোফোন

আনন্দ নেমে আসছে আজ অনেকদিন পর
বড়ো বিস্ময়, বড়ো বটশাখা আন্দোলন অলিন্দে অকারণ। তোমার চরমপত্র নিভে
যাওয়া আলোর পাশে, পানিভাঙা পথ ভেঙে এইমাত্র দাঁড়ালো এসে, বড়ো ভালোবেসে
স্যাক্সোফোন উঠল বেজে। হলুদ আগুনে যারা শুয়ে থাকে রাতভর তাদের বুকের ঘরে
ধরফর খবর পুড়তে থাকে, কিন্তু তারা পুড়ছে না নিজে

অপূর্ব তোমার দেশে মাঝিহীন নাও ভাসে শ্বাসে নিঃশ্বাসে। অনেকদিন পর তার নামের
অক্ষরে একদল পিঁপড়ে হাঁটে। আমি জানতাম না এত মিষ্টি সেই নামে শুয়ে আছে

জ্যোস্না মগ্নতায়

কতকাল অপেক্ষা করে আছে একটি সময়োচিত অভ্যর্থনার জন্যে। বাসে ট্রেনে
বিমানে যেখানে যেভাবে গেছে, শুধুই অপেক্ষা করেছে। সময় মতো কেউই
আসেনি। দূর কোনো শহরে অচেনা প্রতিধ্বনির মাঝে, লাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে
থেকেছে। বাসস্ট্যান্ড, স্টেশন, এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখেছে—
কতজনার কতজন এল-গেল শুধু সে-ই একাকী

বরিশালের মেয়েটি। যে কিনা বগুড়া রোডের সর্বানন্দ ভবনের বাসিন্দা কবি
জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে বিশেষ অন্তরঙ্গ ছিল বলে, সেও দেখেছিল— শহরের
গ্যাসের আলো ও উঁচু-উঁচু মিনারের ওপরে নক্ষত্রেরা অজস্র বুনোহাঁস হয়ে
দক্ষিণ সমুদ্রের দিকে উড়ে চলছে। আর তা দেখতে দেখতে দূরতম ট্রাম লাইন
তাদের বুকে ছায়া ফেলে, ডাকে। কেউ-ই সময় মতো আসেনি, এবার সে-ও
জ্যোৎস্না মগ্নতায় জীবনানন্দের হাত ধরে হাঁটতে থাকে

ইডিপাস কন্যা

সেটা ছিল আমার ভালোবাসা ফিরিয়ে দেয়া-নেয়ার শব্দ কৌশল। বারবার ফিরে গেছি
ইডিপাসকে ভাই বলে ডেকেছি, আর সে তখন অন্ধ দুচোখে রক্ত ঝরাতে ঝরাতে
চলে গেছে দূর পর্বতের দিকে। শূন্য থলিতে করে কেবল নিয়ে গেছে যোকাস্টার
দীর্ঘশ্বাস, মৃত্যুময় হা হা

চারটি কোরাস এসে গান গায়, আজ তোমাদের মৃত্যু নয়, নতুন করে বাঁচা। আমি লাঠি
হাতে ওদেরকে তাড়াই— দূর হ, চলে যা জিউসের বাড়ি! আমার মা ছিলেন যোকাস্টা
বাবা ইডিপাস। আমার কী দুঃখ আছে, কেন তোরা গান গাস, দূর অলিম্পাস রানি করে
নিয়ে যাবে কথা দিয়েছি

ফেরদৌস নাহার ১

ফেরদৌস নাহার

জন্ম বেড়ে ওঠা সবই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে। তবু নির্দিষ্ট কোনো জেলা নয় পুরো দেশটাকেই বাড়ি মনে করেন। পথের নেশা তাকে করেছে ঘরছাড়া। ঘুরতে ঘুরতে এখন আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ে, কানাডায়। সেখানে জীবন যাপনের পাশাপাশি জীবন উৎযাপন করেন কবিতা এবং লেখালিখির খরস্রোতা নদীতে বৈঠা বেয়ে। কবিতার পাশাপাশি লিখছেন নানারকমের গদ্য, অনুবাদ ও আঁকছেন ছবি। বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ডদল ‘মাইলস’-এর সংগীত রচয়িতাও। প্রিয় বিষয় মানুষ এবং প্রকৃতি। প্রকৃতির মাঝে সবচেয়ে প্রিয় সমুদ্র। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে ১৩টি কবিতা ও ৩টি প্রবন্ধের বই। কবিতা: ছিঁড়ে যাই বিংশতি বন্ধন(চর্যাপদ ১৯৮৬), সময় ভেঙ্গেছে সংশয় (নিখিল ১৯৮৭), উলঙ্গ সেনাপতি অক্টোপাস প্রেম (নসাস ১৯৮৮), দেহঘর রক্তপাখি (চর্যাপদ ১৯৯৩), সমুদ্রে যাবো অবিচল এলোমেলো (বিশাকা ১৯৯৬), বর্ষার দুয়েন্দে (শ্রাবণ ২০০১), উদ্ধত আয়ু (অন্যপ্রকাশ ২০০৯), বৃষ্টির কোনো বিদেশ নেই (ভাষাচিত্র ২০০৯), পান করি জগৎ তরল (অ্যাডর্ন ২০১০), চারুঘাটের নৌকোগুলো (আড়িয়াল ২০১৩), নেশার ঘোরে কবিতা ওড়ে (আড়িয়াল ২০১৩), পাখিদের ধর্মগ্রন্থ (কৌরব ২০১৫), নাভি ও নন্দন (চৈতন্য ২০১৫)। প্রবন্ধ: কবিতার নিজস্ব প্রহর (প্রত্ন ২০০২), পশ্চিমে হেলান দেয়া গদ্য (আড়িয়াল ২০১২), কফি শপ (বাহান্ন প্রকাশ ২০১৫)। এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারত থেকে বারোটি যৌথ কবিতা সংকলন। ইমেইল : ferdousnahar@yahoo.com

লেখকের অন্যান্য পোস্ট

লেখকের সোশাল লিংকস:
Facebook

Tags: ,

লেখকের অন্যান্য পোস্ট :

সাম্প্রতিক পোষ্ট