সাম্প্রতিক

সংকট । কেতু মন্ডল

অনেক দিন হলো আকতারের সাথে দেখা নেই। ওর বাড়িতে গেলে আফরোজা তার খোঁজ জানতে চাইলে আমি তার কোন খোঁজ দিতে পারি নি। বেশ কিছু দিন হলো সে নাকি বাড়ি ফেরে না, কোন খোঁজ খবরও নেয় না। আকতারের দূর্গত পরিবারের সাথে সেই রাতটা আমাকে থাকতে হলো, কারণ বাড়িতে ফেরার কোন উপায় ছিল না। মধ্যরাতে গভীর ঘুমে চারপাশ যখন তলিয়ে আছে তখন আমি সন্দিহান হয়ে পড়ি। আকতার যদি আর ফিরে না আসে, শিশু সন্তান নিয়ে আফরোজার অবস্থা কেমন দাঁড়াবে, আমার পাওনা টাকা ফেরৎ না পেলে তখন কী হবে। রাত সব কিছু নীরব করে দিয়েছে, আফরোজা শোয়ার জন্যে তাড়া দিচ্ছিল। কিন্তু আমি কি করবো, মা-কে না বলে বাড়ির বাইরে রাত কাটানো, মা’র মনের অবস্থা কেমন হতে পারে, আমি আফরোজার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকাই। আলো আঁধারী দৃষ্টি বিনিময়ের হেঁয়ালী মেঘমুক্ত আকাশে আমাদের ঢেকে রাখলো মহাজাগতিক পাত্রে।

রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আফরোজার কথা মনে পড়ে। এক অদ্ভূত স্বপ্নে ঘুম ভাঙ্গলো, মাথা বিহীন আমি দিব্যি বেঁচে বর্তে আছি। স্বপ্নের মধ্যে ভাবছি, এটা কী করে সম্ভব এবং অবাক হলাম দুলারীর চিৎকার দেখে। মাথা বিহীন আমার কোন অসুবিধা নেই অথচ সে ভয় পায়।

আকতারের বাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর আমি আরো বেশী পরিত্যক্ত হয়ে পড়ি এবং আমার দিন গুলো পচা ডিমের মত ঘোলাটে হয়ে ওঠে। তবুও পিটার গোমেজের ওখানে যাওয়া আসার কারণে ইলার সাথে সৌহার্দ ভাব হলেও আম্বিয়া বেগম বিভিন্ন ইঙ্গিতে ইলার মতি গতি প্রকাশ করেন। এর ফলে আমার প্রতিদিনের বিষয় গুলো দাঁড়িয়ে যায় দুলারী ইলা দ্বন্দে¡। আকতারকে কোন ভাবে খুঁজে বের করতে না পেরে দুলারীকে এড়িয়ে চলতে থাকি। দুলারীকে এড়িয়ে চলার কারণ হলো এই যে, আমি কপর্দক শূন্য হয়ে পড়ি। দুলারীর সাথে একটা দূরত্ব তৈরী হয় এবং আমি তা সইতে পারি না।

ইলার কাছে যাই এই আশা নিয়ে হয়ত পিটার গোমেজের ওখানে আকতারের দেখা মিলতে পারে। আকতারের  খোঁজ পাওয়া আমার জন্যে জরুরী হয়ে দেখা দেয়। আবার এমনো ভাবতে থাকি যে ইলাকে আমার বুঝে আনতে পারলে একটা সমাধান বের করতে পারবো। পিটার গোমেজের সহায়তা পেলে আকতারের কাছ থেকে টাকা ফেরৎ পাওয়া সহজ হবে, তখন সব ছেড়ে দুলারীকে নিয়ে একটা পরিকল্পনা করা যাবে, আমার একটা গতি হবে।

ইলার সাথে ঘনিষ্ঠতা গাঢ় হওয়ার প্রাক্কালে আম্বিয়া বেগম এমন কান্ড করে বসলেন, তাতে ইলা বিরক্ত ভাব দেখালে আমি তাকে বুঝাতে চেয়েছি এই বলে যে, আমার করার কী আছে।

ইলা মুখ ঝামটে বললো, কেন, ডাকলেই যেতে হবে!


মুহুর্তে ভেবে সব ঠিক করি, দুলারীর সাথে যে সময় কাটালাম তা নিয়ে অযথা ভাবার কিছু নেই। কিন্তু দুলারী ব্যাপারটা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে, অস্ফুট ভোরেদুলারী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে মোয়াজ্জেমের সুরেলা কণ্ঠে সোডা বোতলের ছিপি খোলার শব্দের মত রাতের নীরবতা ভেঙ্গে যায়


আমার প্রতি আম্বিয়া বেগমের অতি আগ্রহে ইলা বেশ ক্ষুদ্ধ, কিন্তু তার কখনও মনে হয় না যে সে আমাকে বসিয়ে রেখে ফোনে কথা বলে সময় পার করে দেয়, আম্বিয়া বেগম এই কথাই আমাকে বলছিলেন।

আমি কিছু বলতে পারি না, ইলার অবহেলা তীব্র ভাবে দেখা দিলেও আমি তা আমলে না নেয়ার কারণে আম্বিয়া বেগম যখন আমার প্রতি সদয় হন তখন মনে হয় সুযোগ পেলে ইলাকে ছাড়বো না। আকতার প্রথম যেদিন পিটার গোমেজের ওখানে নিয়ে গেল, ধনী প্রভাবশালী ব্যক্তির মেয়ে ইলাকে দেখে যেমন লেগেছিল, তার মা আম্বিয়া বেগম আরো বেশী অন্য রকম। তবে তিনি বাড়ির কর্তৃ। হয়েও নিজেকে আলাদা করে রেখেছেন, সবার মাঝে তিনি দিক্ভ্রান্ত একজন।

ইলার কথা মৃদু গুঞ্জরণে ভেসে আসে, কিন্তু তা বিক্ষিপ্ত মাছির বিরক্তিকর ভন্ভনানির মত লাগে।

আম্বিয়া বেগম আবার বলা শুরু করেন, ইলা যে অন্যের সাথে কথা বলে, নিশ্চয় তোমার খারাপ লাগে? জীবন কালে কম দেখলাম না, আঁকড়ে ধরে রাখা, অহেতুুক যন্ত্রণা। আম্বিয়া বেগমের বিমর্ষ চেহারা, অবিন্যস্ত চুলের গোছা বাঁ গালের চোয়াল বেয়ে চিবুক ছুঁয়ে রয়েছে, তাঁর চোখের কোলে ক্লান্তির ছাপ লেপ্টে আছে। কিন্তু তোমরা সব পার, আকাশের রঙ বদলের মত কেমন বদলে যাও। তাঁর শরীরের এক অংশে আলোর প্রতিফলন, ঘোর লাগা স্পর্শাতীত রূপ আমার অনুভবে ছড়িয়ে দেন। বিভিন্ন ভাবে ইলার মনের গতিধারা তুলে ধরার প্রচেষ্টায় তিনি নিজেকে মেলে ধরেন। তাঁকে নোতুন ভাবে দেখে অবাক হই, শামুকের মত গুটিয়ে থাকা বহিরাঙ্গের যে ধারণা তা নড়ে ওঠে। তানপুরার বাজনার মূর্ছনা বিশৃঙ্খল  ভেঙ্গে পড়ার মত আমার মনের সুর কেটে যায়। ক্লান্ত বোধ করি, নিজের কাছে বোঝা হয়ে উঠি, শরীর যেন মনের উপর চেপে বসে, দূর্বল গাধার মত তা আর টেনে নিতে পারি না। রাতে নীরবে কোন ভাবে ঘরের অপ্রস্তুত বিছানায় পৌঁছে দিই নিজেকে।

মা গেছে খালা বাড়ি, আমি একা। বাইরের জগৎ ধাতব পাতের মত চক্চক্ করছে। আম্বিয়া বেগম সব এলোমেলো করে দিয়েছে, ইলা যৌবনের আগুন জ্বালিয়ে দেয়, আফরোজা, পিটার গোমেজ আকতার এবং দুলারীকে ভাবতে থাকি। ইলার প্রতি আকর্ষণ, আম্বিয়া বেগম যে ভাবে নিজেকে মেলে ধরেন, সময় পরিসরে সবাই এক হয়ে যায় এবং আফরোজার কথা মনে পড়লো। রাতটা ব্যাপক এবং অপরিচিত লাগলো। বাড়ির উত্তরে আমড়া গাছে কোক পাখি ডেকে ওঠে, দূর থেকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ভেসে আসছে।

দরজাটা খোলা যাবে, দুলারীর কণ্ঠ শুনে চমকে উঠি, অথচ আমি এটাই চেয়েছি। ফোলা চোখ, ক্লিষ্ট মুখ, দুলারীকে বিপর্যস্ত লাগে। আমার প্রতি তাচ্ছিল্য মিশে ওকে করেছে করুণাঘন।

আপনাকে পাওয়া মুশকিল।

তাই বলে এত রাতে!

তাতে কী, আমি যে অনেক আশা করে আছি।

আমরা আশা নিয়ে বেঁচে থাকি, দুঃখ ছাড়া আর কী পাই বলো?

কিন্তু আপনাকে আমার দিকটা ভাবতে হবে।

যে চক্রে জড়িয়ে গেছি, তুমি যাই বলো কেন, প্রয়োজন তোমাকে ছাড়বে না।

আপনার হাল ছাড়া ভাব, অথচ কত জনে কী না করছে।

আমি দুঃখিত, কী করবো? দুলারীকে অনুধাবণে টেনে আনতে চাই।

আমরা শুরু করতে পারি, আবেগ এবং নিরাশায় দুলারী চেষ্টা করে শক্ত ভীতের উপর দাঁড়াতে। তার উপস্থিতি শীতের সকালের রোদের মত উষ্ণতা আমার অনুভবে মিশে যায়।

টাকা পয়সা না থাকলে ভালবাসা ফিকে হয়ে আসে।

যতটুকু দরকার, অনেকেই কষ্ট করে, না হলে আমরাও। খারাপ কীই বা হবে।

ভবিষ্যৎ,  সেখানে কী আছে তা জানি না।

এক সাথে অনেক কিছু করা যায়।

কিন্তু তবুও তাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি না। অদৃশ্য সুতা যেন আমাকে নিয়তি নির্ধারিত বিশ্রী এক অবস্থায় বেঁধে রেখেছে। দুলারী আমাকে ঘৃণা করার রুচি হারিয়ে ব্যঙ্গ হাসি হেসে ওঠে।

আপনার ভীরুতা কোন করুণা জাগায় না। সে পায়চারী করে। জ্যোৎস্না ধোঁয়া আকাশ, শীতের আমেজ বিড়ালের পায়ে নেমে আসছে। নিঝুম রাত, ফাঁকা বাড়ি, দুলারীর উপস্থিতি, আম্বিয়া বেগমের ওখান থেকে তাড়না নিয়ে ফিরে আসা। দুলারী যেন সেই অতীত কাল থেকে এখানে রয়েছে, আমি তার গন্ধে ইলাকে পেয়ে যাই এবং আম্বিয়া বেগমের উপচীত দেহে আটকে যেতে থাকি। দুলারীকে বিছানায় নিই, সে আমার হাত কামড়ে দেয়। বন্দী হরিণীর ব্যর্থ ছটফটানি জেগে ওঠা তার শরীরে আমার অবস্থান। দুলারী পিষ্ট হতে থাকে, তার শরীরী বাঁকে, অস্ফুট কষ্ট উচ্চারণে ইলাকে অনুভব করি, অনুভবের একই কেন্দ্রে আম্বিয়া বেগম এবং আফরোজাকে মনে পড়ে। দুলারী কেঁপে কেঁপে আমার মাঝে শূন্যতা জাগিয়ে তোলে, তার উম্মোচন আমাকে আঁধারে ডুবিয়ে দেয় কিন্তু আমার শারীরিক বিচলন আর থাকে না। সে পাশ ফিরে শোয়, তার নিতম্ব গোড়ালী গ্রীবায় রাত ফিকে হয়ে গেছে।

কিছু বলার নেই, আপনার প্রতি অভিযোগ, পোষাক পরতে পরতে দুলারী আরো বললো, আপনি শুধু নিজের কথাই ভাবলেন, তার দু’চোখ বেঁয়ে ধাতব আঁধার তরল ঝরতে থাকে, অনিশ্চয়তা ওর চোখের স্বচ্ছতা কেড়ে নিয়েছে। এর আগে তাকে এত অসহায় লাগে নি। ওর চেতনা প্রখর বুঝিয়ে দেয় বৈরী সময়ের আঁচড়ে তার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। সে বিড় বিড় করে আরো বলে, নিজেকে এভাবে নষ্ট করতে পারেন না, তার কথার রেশ চার দেয়ালের মাঝে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

রাত কেটে যাচ্ছে, আমি গুটিয়ে যেতে থাকি, যদি কেউ দেখে ফেলে। যে কোন শব্দে আমি চমকে উঠি। হঠাৎ করাঘাতে দুলারীর বুকে মুখ লুকাই, মা’র বুকে এভাবেই লুকিয়ে ছিলাম, বাবা দরজা খুলে দিল, সে দিনও আকাশে ছিল অঢেল জ্যোৎস্না। অস্ত্রের মুখে ধরে নিয়ে গেলে রক্তাত্ত বাবাকে পেয়েছিলাম নদীর ধারে। দুলারী কানে কানে বললো, আপনাকে কে যেন ডাকছে, ওর মনোবিচলন কেটে যায়। আমি উঠতে চাই কিন্তু ছাড়ে না। মা ও বাবাকে ছাড়তে চায় নি। আকতারের গলা শুনে আশ্বস্ত হই। দুলারীকে দেখে সে থমকে যায়। নিষ্ঠুর তার মুখোভাব, জামায় রক্তের দাগ। আমাকে বললো, ভয়ের কিছু নেই, এমনই সব কিছু।

আকতারকে আমি চিনতে পারি নি, তার কথার ধরন বদলে গেছে, তোতলামো ভাব একেবারেই নেই, কিন্তু অস্থির সে। আমাকে একটি ব্যাগ দিল এবং বললো, এটা রাখুন, সময় করে নিয়ে  নেব, পারলে আফরোজার খবর নেবেন। তার চোখে উদ্ভ্রান্ত ভাব লেগে আছে, আকতার দ্রুত বেরিয়ে গেল। দূর থেকে কুকুরের ডাক এখনো ভেসে আসছে, কোক পাখি ডেকে চলেছে।

দুলারী পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করে, জিজ্ঞেস করলো, লোকটা কে?

আকতার, এক সাথে ব্যবসা করি।

এত রাতে কী দিয়ে গেল?

দেখতেই পাচ্ছ, এটা একটা ব্যাগ।

কি আছে?

কি করে বলবো, খুলে দেখলেই হয়।

দুলারী ব্যাগটা খুলে আমার দিকে তাকায়। ব্যাগ ভর্তি টাকা। আমি কিছু বুঝতে পারি না, তবে মনে মনে খুশি হই। মুহুর্তে ভেবে সব ঠিক করি, দুলারীর সাথে যে সময় কাটালাম তা নিয়ে অযথা ভাবার কিছু নেই। কিন্তু দুলারী ব্যাপারটা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে, অস্ফুট ভোরেদুলারী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে মোয়াজ্জেমের সুরেলা কণ্ঠে সোডা বোতলের ছিপি খোলার শব্দের মত রাতের নীরবতা ভেঙ্গে যায়।

ব্যাগটা মাথার কাছে নিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি, কিন্তু ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি দুপুর সাথে করে দুলারী দাঁড়িয়ে আছে। সে অচেনা কাউকে  দেখছে এমন করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার কাছে জানতে পারি পিটার গোমেজ খুন হয়েছেন, তাঁর অফিস থেকে অনেক টাকা লোপাট হয়েছে।

আমার কাছে টাকার ব্যাগ, রাতে আকতারের আগমন। সে চাপা গলায় আমাকে বললো, আপনাকে কী ভাববো?

দুলারী আমাকে কী ভাববে, আকতার ওভাবে এসে টাকার ব্যাগটা আমাকে দিয়ে গেল কেন?

ফাঁকা বাড়িতে দুলারীকে নিয়ে হতবিহ্বল আমি!

কেতু মন্ডল

জন্ম ও বেড়ে ওঠা লালনের ভিটে কুষ্টিয়ার আড়ুয়াপাড়ায়। কবিতার সাথে দিন রাত বসবাস ছেলেবেলা থেকে। তিনি জীবনের নানা ভাবনার মাঝে কেবল লিখে যেতে চান। 'পাঁজরের প্রতিধ্বনি' কেতু মণ্ডলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ।

লেখকের অন্যান্য পোস্ট

Tags: , , , ,

লেখকের অন্যান্য পোস্ট :

সাম্প্রতিক পোষ্ট