
সিনেমা দেখতে বা উপলব্ধি করতে আমরা চোখ ও কান ব্যবহার করি, এটা খুব সাধারণ কথা; — কিন্তু অতীতে অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলোকেও এতে নিযুক্ত করার চেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে করা হয়েছে।
১৯৭৪ সালে নির্মিত ‘The Earthquake’ সিনেমায় ‘Sensoround’ নামক একটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিল। ফিল্মের একটি ট্র্যাকে সিগ্ন্যাল রেকর্ড করে একটি অসিলেটরের মাধ্যমে অত্যন্ত নিচু ফ্রিকোয়েন্সির শব্দতরঙ্গ তৈরি করা হয়েছিল অডিটোরিয়ামে। বিশেষভাবে স্থাপিত স্পিকার সিস্টেমের দ্বারা বাজানো হয়েছিল সেটা, যাতে করে সিনেমাতে ভূমিকম্পের দৃশের সময় এই উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন নিচু ফ্রিকোয়েন্সি দর্শকদের শরীরে কম্পন সৃষ্টি ক’রে এবং পুরো বিল্ডিঙটাই কাঁপছে — এমন একটা অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। ‘sensoround’-এর শ্রুতিগম্য অংশটিও ছিল গগনবিদারী, যা পুরো বিষয়টাকে আরও ভয়ঙ্কর করে তোলে।
সিনেমায় ঘ্রাণের অনুভূতি দেয়ার জন্য “Odorama” নামক একটি পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় ১৯৮১ সালে নির্মিত “Polyester” ছবিতে। দর্শকদের একটা করে ছোট কার্ড দেয়া হতো; সিনেমার বিভিন্ন মুহূর্তে এই কার্ড ঘষে গন্ধ শুঁকতে হতো।
দুটি উদ্যোগই অসফল এবং দ্রুত বিস্মৃত হয়ে যায়। অংশত, সিনেমা এই পদ্ধতিগুলো থেকে উপকৃত হওয়ার অনুপযুক্ত ছিল। তাছাড়া গন্ধযুক্ত কার্ড ঘাঁটাঘাঁটি কিংবা শারীরিক কাঁপাকাঁপি আসলে দর্শকদের অনুভূতির ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। যদিও মৌলিক ধারণাটি মোটেও খারাপ ছিল না।
আমার বইটি ‘Ljudbild eller synvilla?’ (‘সাউন্ডস্কেপ না মরীচিকা?’ — বর্তমানে কেবল স্যুইডিশ ভাষায় পাওয়া যাচ্ছে) লেখার সময় কিছু গবেষণা করেছিলাম উপলব্ধির দৃষ্টিকোণ থেকে দৃষ্টি ও শ্রুতির পার্থক্য নিয়ে। এই ইন্দ্রিয়গুলো যে আলাদাভাবে উপলব্ধিকে প্রভাবিত করে, সে-ব্যাপারে আমি সচেতন ছিলাম। কিন্তু পার্থক্যগুলো আসলে কী কী এবং কীভাবে সাউন্ড-এডিটর বা সাউন্ড-ডিজাইনাররা এ থেকে উপকৃত হতে পারে? স্যুইডিশ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে শব্দ নিয়ে ১৫ বছরের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি এতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, ওয়াল্টার মার্চ কিংবা রেন্ডি থম ও অন্যান্যদের শব্দবিষয়ক লেখাগুলো সম্ভবত ঠিক, কিন্তু আমি আগ্রহী হয়েছিলাম তাদের নির্ভুলতার জায়গায়।
সাধারণ ধারণা হচ্ছে, ঘ্রাণের মতো শব্দও আমাদের অবচেতনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। অবচেতনে ঘ্রাণের দখল নিয়ে কারো মনে সংশয় থাকলে যে-কোনো ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের পার্ফিউম কাউন্টারে জরিপ করে দেখতে পারেন : শরীরের গন্ধ পরিবর্তনের জন্য মানুষ কত খরচ করতে ইচ্ছুক।
আমার মনে হয়, উপলব্ধির প্রধান হাতিয়ার দৃষ্টি; ঘ্রাণ ও শ্রুতি সহায়কের ভূমিকা পালন করে। সুদর্শন কারো গা থেকে সুগন্ধ পেলেই আমাদের অনুভূতি তৃপ্ত হয়, অদ্ভুত কোনো গন্ধ পেলে একটু কেমন যেন লাগে। অন্যভাবে বলা যায়, গন্ধ যদি দৃশ্যকে সমর্থন করে তবে আমরা বিষয়টি নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাই না, কিন্তু যদি তা না ঘটে অর্থাৎ ঘ্রাণ ও দৃশ্য পরস্পরবিরোধী তথ্য দেয়, তাহলে আমাদের মস্তিষ্ক বিচলিত হয়ে পড়ে। কেন? কারণ সেক্ষেত্রে আমদের চোখ ও কানের দেয়া অসামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্যগুলোকে মস্তিষ্ক আলাদাভাবে যাচাই-বাছাই করে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়।
‘Fight Club’ ছবিতে মার্লা (হেলেনা বনহাম কার্টার) একজন গড়পড়তা আকৃতির মহিলা, কিন্তু বাড়ির ভেতর তার হাঁটাচলার শব্দ শুনে মনে হয় একজন ভারী পুরুষ স্লালম বুট পায়ে হাঁটছে। দর্শক এ থেকে একটা আলামত পায় — চরিত্রটিকে যেমন দেখা যাচ্ছে তার বাইরেও কোনো ব্যাপার আছে। স্পষ্টত এটি কুশলী ফলি-র পরিণাম, যা চরিত্রটি চিত্রণে বিশেষ মাত্রা যোগ করছে, মুখ্য চরিত্রটির (এডওয়ার্ড নর্টন) দৃষ্টিকোণ থেকে। আমরা এই বৈশিষ্ট্যগুলো চরিত্রটির ভিতরে দেখতে পাই, যদিও শুধু শব্দের মাধ্যমেই তথ্যগুলো দেয়া হচ্ছে। একই সাথে মার্লা-র প্রতি তার অনুভূতিও বুঝতে পারি, কারণ তার (মূল চরিত্র) সাথে সাথেই একসঙ্গে বৈশিষ্ট্যগুলো অনুভব করছি।
ব্রেইন সার্জারি ফর ডামিস
এটা স্পষ্ট যে, বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্নভাবে তাদের মস্তিষ্ক ব্যবহার করে। কেউ সাংগীতিক, কেউ রেসের গাড়ি যে-কারোর চেয়ে দ্রুত চালাতে পারে, আবার কেউ আঁকতে পারে ভালো। যদিও সবার মস্তিষ্ক কম-বেশি একই রকম দেখতে এবং কর্মপদ্ধতিও অভিন্ন — তথাপি এই পার্থক্যগুলো থাকে।
একজন সাধারণ মানুষের সামর্থ্য-অসামর্থ্যের ব্যাপ্তি মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত খুব উদার হই। একজন মধ্যবয়স্ক লোকের আঁকার হাত ছয় বছরের বাচ্চার মতো হতেই পারে, গাইতে বা কিছু বাজাতে না-জানাটাও গ্রহণযোগ্য।
বলা হয়ে থাকে, মস্তিষ্কের বাম অংশ যুক্তিনির্ভর কাজ পরিচালনা করে, যেখানে ডান দিকটা মূলত অনুভূতি ও সৃষ্টিশীল অংশ। শরীরের বামপাশ নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্কের ডান-অর্ধ দিয়ে আর ডানপাশ নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের বাম-অর্ধ।
কিন্তু, একজন বাঁহাতি ব্যক্তির ক্ষেত্রে কিছু কিছু যুক্তিনির্ভর কাজ পরিচালিত হয় মস্তিষ্কের ডান অংশ দিয়ে, কিন্তু সব নয়। সাধারণভাবে বললে, একজন বাঁহাতি ব্যক্তির কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে যা একজন ডানহাতির থেকে আলাদা। একজন ‘সাধারণ’ ব্যক্তির সামর্থ্য-অসামর্থ্যের এই ব্যাপক বৈচিত্র্যের কারণে একই দৃশ্য বা সংগীত আলাদা আলাদা ব্যক্তি কীভাবে অনুধাবন করবে তা সম্বন্ধে আগাম অনুমান করা একেবারেই অসম্ভব।
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মস্তিষ্কের একটি অংশ অন্য অংশগুলোর কাজে বিঘ্ন ঘটাতে পারে বা অবদমন করতে পারে। যদি কোনো-একটি অবদমিত অংশ আঘাতপ্রাপ্ত হয়, ব্যক্তি হঠাৎ নাটকীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে পারে। প্রবীণ ব্যক্তিদের মধ্যে এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে, মস্তিষ্কের অংশবিশেষ স্মৃতিভ্রংশের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরে হঠাৎ করে তারা চিত্রাঙ্কন কিংবা সংগীতে পারদর্শী হয়ে উঠেছে, যা তারা আগে পারত না।
কিছু মাদকেরও অনুরূপ প্রভাব রয়েছে বলে প্রতিভাত হয়, এগুলো মস্তিষ্কের বিশেষ বিশেষ অংশের কর্মক্ষমতা বন্ধ করে দিয়ে অবদমিত অংশগুলোকে কাজের সুযোগ করে দেয়; — পরিণতি, অমূলপ্রত্যক্ষ (হ্যালুসিনেশন) এবং বাস্তবতার বিকৃত উপলব্ধি।
আমরা যখন সিনেমা বানাই, দর্শকের বাস্তবতার বোধকে বিকৃত করাই থাকে আমাদের উদ্দেশ্য। ৯০ মিনিটের জন্য আমরা এই বিভ্রম তৈরি করতে চাই যে — থিয়েটারের শেষপ্রান্তে অবস্থিত পর্দাটির মধ্যেই আসলে বাস্তবতা, এবং দ্বিমাত্রিক চিত্রগুলি আসলে ত্রিমাত্রিক। মূলত শব্দই এই তৃতীয় মাত্রা অর্থাৎ গভীরতা তৈরি করার পেছনে কাজ করে, কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক ভাবায় আমরা আসলে দেখছি।
আমাদের মস্তিষ্ক কিভাবে সঙ্গীত অনুভব করে তা নিয়ে গবেষণা করেছেন একজন ইংলিশ ভায়োলিনবাদক প্রোফেসর পল রবার্টসন। তার কিছু বিস্ময়কর আবিষ্কার উপস্থাপিত হয়েছে ‘মিউজিক অ্যান্ড দি মাইন্ড’ নামক টেলিভিশনসিরিজে।
আরও অনেক কিছুর সাথে তিনি একটি গবেষণা উপস্থাপন করেন যেখানে একজন পুরুষের মস্তিষ্ক এক্স-রে করা হয়, যে কিনা একটি ছোট কিবোর্ডে স্কেল অনুশীলন করছেন এবং ‘বাখ’ বাজাচ্ছেন। এই পরীক্ষার একটি অত্যাশ্চর্য ফলাফল হচ্ছে, মস্তিষ্কের যে-অংশ শ্রুতি নিয়ে কাজ করে সেটি নিষ্ক্রিয় থাকে বাজানোর সময়। অন্যদিকে যে-অংশ দৃশ্য নিয়ে কাজ করে, বাখ বাজানোর সময় সেটি সচল থাকে; কিন্তু স্কেল প্র্যাক্টিস করার সময় না। উল্লেখ্য, হুয়ান সেবাস্তিয়ান বাখ কিংবা যে-কারো মিউজিক বাজানো একটি সৃষ্টিশীল কাজ, অপরদিকে স্কেল অনুশীলন সৃষ্টিশীল কাজ নয়।
অন্য একটি অংশে তিনি লন্ডন সিম্ফোনি অর্কেস্ট্রার একজন বধির ভিয়োলাবাদকের সাক্ষাৎকার নেন। এ-রকম কীভাবে সম্ভব জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, শ্রুতি হচ্ছে অত্যন্ত জটিল একটি প্রতিক্রিয়াব্যবস্থার অংশ মাত্র, যা বাজানোর সময় কাজ করে। তিনি আরও বলেন, এবং আমার মতে এটাই সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক, সব সংগীতশিল্পীই বাজানোর সময় শ্রবণেন্দ্রিয়ের সাথে সাথে অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলোও ব্যবহার করে — তারা শুধু বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নয়। যখন আমরা কিছু শুনি, কোনো কারণে মস্তিষ্ক আমাদের বিশ্বাস করায় যে, আসলে আমরা অনুভব করছি অথবা দেখছি, আবার যখন কিছু দেখি তখন মনে হয় যেন শুনছি। কেন?
ইন্দ্রিয়সমূহের ব্যান্ডউইথ
আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহের তথ্য আদান-প্রদানের সামর্থ্য পরিমাপের একাধিক প্রচেষ্টা অতীতে হয়েছে। যেমন, চোখের স্নায়ুকোষের সংখ্যা এবং প্রতিটি কোষের তথ্য আদানপ্রদানের সর্বোচ্চ পরিমাপ দিয়ে বিজ্ঞানীরা এটি সঠিকভাবে হিসেব করতে সমর্থ হয়েছেন। নিচের সংখ্যাগুলো ডিজিটাল তথ্যের একক বিটস্/সেকেন্ড (b/s)-এ অনূদিত :
ইন্দ্রিয় | ব্যান্ডউইথ (b/s) |
দর্শন | ১0,000,000 |
শ্রবণ | ১00,000 |
স্পর্শ | ১,000,000 |
স্বাদ | ১,000 |
ঘ্রাণ | ১00,000 |
মোট | ১১,২0১,000 |
দর্শন এবং শ্রবণের সক্ষমতার অনুপাত ১০০ : ১। অনুমান করছি, সিনেমার শব্দের সাথে জড়িত সবাই এটি আগেই সন্দেহ করেছেন। এটাও বেশ কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য — ঘ্রাণ ও শ্রবণ, যাদেরকে কিছুটা পরস্পরসংশ্লিষ্ট বলে ধারণা করা হয়, এর সক্ষমতার অনুপাত ১ : ১ ।
এবারে সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ। আমাদের চেতনার তথ্য আদান-প্রদান ক্ষমতার পরিমাপেরও চেষ্টা হয়েছে। এ ব্যাপারটি আরেকটু জটিল। যদিও অভিন্ন কোনো সংখ্যাগত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি, তথাপি এটি সব সময় ১৬-৪০ বিটস্/সেকেন্ডের মধ্যে ছিল। কাজেই দেখা যাচ্ছে, সবগুলো ইন্দ্রিয়ের ধারণক্ষমতার মোট সংখ্যাগত মান এগারো মিলিয়ন বিটস্/সেকেন্ড হলেও আমাদের চেতনা মাত্র ৪০ বিটস্/সেকেন্ডের খোঁজ রাখে। যার অনুপাত ২৭৫,০০০ : ১!
তাৎক্ষণিক যে-প্রশ্নটি মাথায় আসে : বাকিটা কোথায় যায়? স্পষ্টতই এই এগারো মিলিয়নের কিছু অংশ ব্যয় হয় শরীরের তাপমাত্রা ঠিকঠাক রাখার জন্য কী আচরণ করতে হবে — অগ্ন্যাশয়কে এই বিষয়ক উপদেশ দিতে, কিন্তু তারপরও …
আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে : কীভাবে নির্ধারিত হয় কোন তথ্য আসলেই জ্ঞাত হবে, আর কীভাবেই-বা এটা ঘটে?
আমাদের সচেতনতা একটি সঙ্কীর্ণ আলোকরশ্মির ন্যায়, যা একটি বৃহৎ কক্ষের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পরিভ্রমণরত। এটি প্রতিবারে একটু-একটু করে অনেককিছু দৃষ্টিগোচর করতে সক্ষম। তথ্যের এই টুকরা অংশগুলো একসাথে জুড়ে দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র কিংবা ধারণা তৈরি হয়। সারাক্ষণ সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া সচল থাকার কারণে কোন তথ্য সচেতন হবে আর কোনগুলো উপেক্ষিত হবে, তা নির্ধারিত হতে একটু সময় লাগে। ফলে কোনো একটি অনুভূতিতে পৌঁছাতে একটু বিলম্ব ঘটে। কতটুকু? অর্ধ-সেকেন্ড, নির্ভুলভাবে বলা যায়। যে-কোনো ঘটনায় আমাদের সচেতন হতে আধ-সেকেন্ড বিলম্ব ঘটে। কিন্তু আমরা যাতে বিভ্রান্ত না হয়ে পড়ি, তার জন্য মস্তিষ্ক আমাদের বোকা বানিয়ে ব্যাপারটিকে আড়াল করে। খুব সাধারণ একটি পরীক্ষায় বিষয়টি বোঝা সম্ভব। একটি উত্তপ্ত পৃষ্ঠে আঙুল ছোঁয়ালে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অবচেতনেই হাতটি সরে যায়, উত্তাপ অনুভূত হওয়ার পূর্বেই।
দেজা-ভ্যু বা এ-জাতীয় অন্যান্য ঘটনাগুলো বেশ কৌতূহলোদ্দীপক হয়ে ওঠে এই অভিজ্ঞতার আলোকে। আমাদের পুরো জীবনটাই আসলে দেজা-ভ্যু, এই পরিস্থিতির মুখোমুখি আমরা আগেই হয়েছি, আধসেকেন্ড আগে! যখনই আমাদের মস্তিষ্কের এই বিলম্বকারী পদ্ধতি এবং ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্য (সেন্সোরি ইম্পালস) সামঞ্জস্যহীন হয়ে পড়ে, তখন দেজা-ভ্যু অনুভূত হয়।
যেসব তথ্য ইন্দ্রিয়গুলোর মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে এবং এর যতটুকু সম্পর্কে আমরা সচেতন (ও ফলে অন্যদের সাথে সম্পর্কিত হতে সক্ষম) — এই দুইয়ের মধ্যকার অসামঞ্জস্যতা আমাদেরকে এক অর্থে ভীষণ নিঃসঙ্গ করে তোলে। আমাদের কোনো-একটি অভিজ্ঞতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেয়া একেবারেই সম্ভব না। সম্ভবত সবাই কোনো অবচেতন প্রক্রিয়ায় এটা জানি, এবং এ-কারণেই শিল্পীরা সমাদর পায়। আমাদের সবারই রয়েছে বিপুল পরিমাণ অভিজ্ঞতা, কিন্তু তা অন্যদের মাঝে সংক্রমিত করতে পারি না। শুধু শিল্পীরাই মনে হয় এটা পারে। তারা হয়তো তাদের পুঞ্জীভূত অবচেতন-অভিজ্ঞতার একটা আভাস আমাদের দিতে পারে, যা থেকে আমরা ধারণা করতে পারি — অভিজ্ঞতাগুলো এককভাবে শুধু আমাদেরই না, অন্যরাও এগুলোর মুখোমুখি হয়।
চলচ্চিত্রের শব্দে কীভাবে এটি প্রাসঙ্গিক?
ভালো অভিনয় বলতে সম্ভবত পুরো ৪০ বিট/সেকেন্ড দিয়ে কোনো-একটি অনুভূতি সঞ্চালিত করার সক্ষমতাকে বোঝায়। আর যখন শব্দ আর শরীরের ভাষা ভিন্ন কথা বলে, সেটাই খারাপ অভিনয়। শব্দ এডিট করার সময় আমি প্রায়শই চেষ্টা করি শাব্দিক কারণ দিয়ে চরিত্রটির অন্যদিকে তাকানো অথবা কোনো লাইনের হোঁচট খাওয়ার যৌক্তিকতা তৈরি করে অভিনেতাকে সাহায্য করতে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিনয়ের সাথে লাইনের সারবস্তুর সেতুবন্ধন তৈরি করে ধন্যবাদ পাওয়া তো দূরের কথা, দেখা যায় কোনো অভিনেতা হয়তো এ-ব্যাপারটি লক্ষই করেননি। কিন্তু এটাই স্বাভাবিক আমাদের কাজের ক্ষেত্রে। এ-কাজে আপনি যতটা সিদ্ধহস্ত, ঠিক ততটা অলক্ষিত।
আমাদের সচেতনতার ব্যান্ডউইথ যদি মাত্র ৪০ বিট/সেকেন্ড হয়ে থাকে, তবে প্রকৃত দৃঢ় অভিজ্ঞতাগুলো বড় অংশে নিশ্চয়ই নিজেদের আভ্যন্তরীণ তথ্য সমন্বয়ে গঠিত হয় — যেসব বিষয় আমরা আমাদের মাথার ভিতরে জমিয়ে রেখেছি। সবচেয়ে ভীতিপ্রদ দৃশগুলোর, যেমন ‘দি ব্লেয়ার উইচ প্রজেক্ট’, প্রকৃত উপাদান কী কী? খুব অন্ধকার, কম্পমান চিত্র যা আসলে যে-কোনো কিছুরই হতে পারে, আর ভারী শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ, ধাবমান পায়ের শব্দ আর মরিয়া চিৎকার। এ থেকে আমি ভয় পাই কেন? কারণ এটা একটা দরজা খুলে দেয়, যার ওপাশে আছে আমার ভেতরকার গহীন শঙ্কা আর উদ্বেগ, আমার নিজের স্মৃতিতে রক্ষিত বিষয়গুলো। এগুলো আমাকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। অর্থাৎ, পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে, অভিন্ন দৃশ্যে, প্রতিজন প্রেক্ষকই আলাদা আলাদা বিষয় নিয়ে নিয়ে সন্ত্রস্ত।
যদি অনুকূল সুযোগ দেয়া হয়, তবে দর্শকের কল্পনাশক্তিই হবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রনির্মাতা, তার ধারেকাছেও কেউ ভিড়তে পারবে না। দৃশ্য যত নিখুঁত হবে, ততই তা দর্শকের আবেগকে স্পর্শ করতে অসমর্থ হবে। চলচ্চিত্রনির্মাতা যত স্পষ্ট হবেন, তার বর্ণনায়, ততই দর্শক হারাবে তার নিজস্ব অনুধাবনের সুযোগ। ক্ল্যাসিক ‘বি’-মনস্টার ম্যুভিগুলো, যেখানে নির্মাতা তার দীনহীন মনস্টারগুলো দেখানোর লোভ সংবরণ করতে পারেন না অথবা অনুত্তেজক যৌনদৃশ্য, যেখানে নির্মাতা প্রেক্ষকের কল্পনার হাতে কিছু ছেড়ে দেন না — এগুলো হচ্ছে তার ভালো (আসলে খারাপ) উদাহরণ।
শুধু একটা সঠিক ট্রিগার দরকার যা অভিজ্ঞতার এই পদ্ধতির সূচনা করবে দর্শকের মনে, আর এই ট্রিগারটা হতে পারে শব্দ।
রেন্ডি থম যখন সাদাকালো ইমেজ কিংবা ধোঁয়া বা ‘এক্সট্রিম ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল’ ব্যাবহার করতে বলেন, তা আসলে এই বিষয়টিকেই সমর্থন করে। পুরোটা প্রকাশ না-করার কারণে দর্শক বাধ্য হয়ে বিকল্প সূত্রের কাছে যায় শূন্যস্থান পূরণের জন্য; যার মধ্যে একটি সূত্র অবশ্যই চলচ্চিত্রের সাউন্ডট্র্যাক। যৎসামান্য দৃশ্যমান উপাদান এবং তাৎপর্যপূর্ণ শব্দের ব্যবহার করে আপনি দর্শকের কল্পনার ঘোড়া ছুটিয়ে দিতে পারবেন।
ট্রিগারটি কতটুকু তথ্য দিয়ে কতখানি সত্য উন্মোচন করবে তা অনুমান করাটা বেশ মজার।
‘গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ দুনিয়ার সংক্ষিপ্ততম পত্রযোগাযোগের একটি ভুক্তি আছে। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে ফরাশি লেখক ভিক্টর হুগো তার উপন্যাস ‘লা মিজারেবল’ শেষ করে ক্লান্ত হয়ে তার গ্রামের গ্রীষ্মনিবাসে অবকাশযাপনে যান। কয়েক সপ্তাহ পরেও বইটি প্রকাশিত ও বিক্রি হয়েছে কি না এবং সমালোচকেরা এটি সম্পর্কে কী ভেবেছেন — সেসব অনুসন্ধিৎসা সংবরণ করতে না-পেরে তিনি তার প্রকাশককে চিঠি লেখেন।
চিঠিটি ছিল এ-রকম :
‘?’
প্রকাশকের ফিরতি চিঠিটা ছিল এ-রকম :
‘!’
স্পষ্টতই প্রশ্ন এবং উত্তর উভয়ের মাঝেই পূর্ববর্তী জ্ঞানের ভিত্তিতে অনেক তথ্য বা তাৎপর্য ছিল, যা ওই ক্ষুদ্রতম তথ্য দ্বারা ট্রিগার হয়েছে।
দৃশ্যের ঠিক সময়টিতে সামান্যতম শব্দের ব্যবহার দর্শককে অনেক কিছু জানিয়ে দিতে পারে সূক্ষ্মতার সাথে। ফলি-তে পায়ের শব্দ তৈরির সময় যদি মেঝেতে ভাঙা কাচ ছড়িয়ে রাখা হয়, তবে তা দর্শককে অস্বস্তিতে ফেলে দিবে, যদিও ভাঙা কাচ মোটেই দৃশ্যমান নয়।
আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে, মুষ্টাঘাত কিংবা গুলি আর গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ছবির চরিত্রের চিত্রণে বিশেষ মাত্রা যোগ করে। বেশিরভাগ সময়ে দর্শকের কাছে এসব ভালো অভিনয় হিসাবেই অনুভূত হয়।
কেন এটি কার্যকরী?
আমাদের মস্তিষ্ক ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের সরলীকরণ কিংবা তাদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করে; এটি আমাদের চেতনার ব্যান্ডউইথ-সীমাবদ্ধতার একটা ফলাফল। মানবজাতি একটি সামঞ্জস্যময় পৃথিবীর উপযোগী করে নির্মিত। আমাদের মস্তিষ্ক সামঞ্জস্যপূর্ণ ঘটনাসমূহের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য প্রস্তুত।
আমাকে যদি আপেল আর নাশপাতির টুকরা দেয়া হয়, আমি সহজেই কোনটা কি তা বলে দিতে পারব; যদিও দুটোই একই রকম দেখতে। কেন? এটা কি এই কারণে যে, আমি এদের স্বাদের পার্থক্য জানি? না, অবশ্যই নয়। মানুষ কেবলমাত্র চারটি স্বাদের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে : নোনতা, মিষ্ট, তেতো আর টক। বাকিগুলো হচ্ছে ঘ্রাণ। তা সত্ত্বেও (এবং বেশিরভাগ মানুষ এ-সম্পর্কে অবগত থাকা সত্ত্বেও), আমরা বিশ্বাস করি যে সবাই স্বাদগুলোর পার্থক্য করতে পারে। কারণ আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের এমনটাই বোঝায়। মুখে যেহেতু একটুকরা ফল ছিল তাই এটির স্বাদ এ-রকম। এই ব্যবস্থাই আমাদের সাহায্য করে ৪০ বিটস্/সেকেন্ড-এর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে।
আমরা জানি যে সিনেমায় হ্যারিসন ফোর্ড কখনোই আরেকজন অভিনেতাকে সত্যি সত্যি তার মুখমণ্ডলে আঘাত করতে দিবে না। সবাই জানি এটা হচ্ছে একটা সমন্বয় — একটা মুষ্টির তার মুখের কয়েক ইঞ্চি কাছ দিয়ে চলে-যাওয়া, সঠিক জায়গায় ক্যামেরার অবস্থান, হ্যারিসন ফোর্ডের সঠিকভাবে বেঁকে যাওয়া, এবং সঠিক ফ্রেমে সুনির্মিত একটুকরা শব্দের ব্যবহার। কিন্তু প্রেক্ষাগৃহের অন্ধকারে সবাই ঘেমে উঠি, যেন হ্যারিসন ফোর্ডের চরিত্রটি ব্যথা পাবে এবং নায়িকাকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হবে। ভীষণ মুষ্টাঘাতগুলোর ভয়াবহতা দেখে বিচলিত হই। তার কারণটা খুব সহজ। আমাদের মস্তিষ্কের সরলীকরণের ফলে শব্দ এবং চিত্রের মিলিত প্রভাবে একাকার হয়ে একটি দৃশ্য অনুভূতি তৈরি করে; — যাতে আমরা দ্বিধান্বিত হয়ে না পড়ি, তার জন্য মস্তিষ্ক পুরো সত্যটা এড়িয়ে গিয়ে বলে, “তুমি এটা দেখছো”। সম্ভবত পুরো সত্যটা জানাতে অনেক বেশি ব্যান্ডউইথ খরচ করতে হবে।
তাহলে ‘অডোরামা’ এবং ‘সেন্সোরাউন্ড’-এর কি হবে? সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে স্পর্শ এবং গন্ধকে আমাদের চেতনার সরলীকরণের মধ্যে ফেলে দৃশ্যের আবেদন অনেক বাড়ানো যেতে পারে, যার ফলে উপকৃত হবে গল্প। যা-হোক, আমি স্বীকার করছি, আপাতত আমি শব্দ আর দৃশ্য নিয়েই খুশি।
মূল : ক্লাস ডায়খফ
প্রোফেসর, ফিল্ম সাউন্ড, ড্রামাটিস্কা ইন্সট্যুট, য়্যুনিভার্সিটি কলেজ অফ ফিল্ম, রেডিও, টেলিভিশন অ্যান্ড থিয়েটার