সাম্প্রতিক

স্মৃতি : জয়নুল আবেদীন । ওমর শামস

আমি তখন নটরডেম কলেজের বিজ্ঞানের ১১-১২ ক্লাসের ছাত্র, ১৯৬৩-৬৫। শান্তিনগরে থাকতাম, পায়ে হেঁটে কলেজ। শান্তিনগর মোড় থেকে ফকিরাপুলের দিকে যে রাস্তা – নাম মনে নেই – তার মাঝামাঝিতে রাস্তার আড়াআড়ি এক গলিতে ঢুকতাম কলেজের পথে। ওই গলিতেই থাকতেন চিত্রশিল্পী, অধ্যাপক জয়নুল আবেদীন। সেকালের ইট-সিমেন্টের একতলা একটি দালান। সেকালে সুরকির গলির পাশে টং জাতীয় কাঠের খুঁটির উপর টিনের বাড়ি ছিল অনেকগুলো। মাঝে কলার গাছ, অন্য ধরণের বাড়িও  ছিলো । ওঁর বাড়ির সামনের মূল ফটকটি অনেক সময়ই খোলা থাকতো এবং জয়নুল আবেদীন-কে দেখতাম চেয়ারে বাইরে তাকিয়ে বসে আছেন, লুঙ্গিপরা হাতে সিগারেট। ঘরে একটা চীনে বা জাপানী স্ক্রোল ছবি টানানো। খোদাই করা কাঠের একটা মোগলাই ধরণের টেবিল ছিলো। কিছু দিন দেখেছিলাম, তাঁরই কোন ছাত্র তাঁকে বসিয়ে পোরট্রেট আঁকছেন। 

ছোটবেলা থেকে আমার ছবি আঁকার সখ, ইচ্ছা দুটোই কিঞ্চিত ছিলো। যখন কলেজে উঠেছি তখনওছিলো। কি দুঃসাহসে অথবা ভুতে ধরায়, একদিন আমি দুটো ছবি এঁকে নিয়ে আচার্যর বাড়িতে হাজির। ছেলেমানুষী প্রচেষ্টা, একটায় নদী, নারকেল গাছ, নৌকো যা সব শিশুই আঁকে, অন্যটায় গ্রামের  জলসায় বাউল গান গাইছে। উনি নারকেল গাছ রেখে বাউলের ছবিটি দেখলেন। কিছু একটা বলেওছিলেন। অবনীন্দ্রনাথের বাগীশ্বরী প্রবন্ধাবলী  পড়তে বললেন। এও বলেছিলেন, অবনীন্দ্রনাথের চেয়েও বড়  শিল্পী হয়েছে। নাম বলেন নি, তবে নিশ্চয়ই আব্দুর রহমান চুগতাই-এর কথা মনে করে বলেছিলেন। একই স্টাইলের শিল্পী হলেই হয়তো তুলনা করা যায়। আরেকদিন যখন গিয়েছি, তখন শহীদ মিনারের নতুন নির্মাণের আর্কিটেকচারের আয়োজন চলছে। সেই বোর্ডে তিনিও ছিলেন। সে কালে আর্কিটেকচারের  নতুন ডিপার্টমেন্ট হয়েছে, তরুণ  স্থপতিরা সব তুর্কি সিনান । সবাই কনটেম্পোরারি আর্কিটেকচার করতে চায়। জয়নুল আবেদীন মৃদু অসন্তোষ দ্যাখালেন। “করো, কিন্তু যা আছে তাকে রেখে মানিয়ে করো। মূল ডিজাইনটাকে রাখো। ট্রাডিশনের একটা মূল্য আছে। ফ্রান্সে গিয়ে দ্যাখো, পুরোনো যা কিছু সব তেমনি রেখেছে।“  মূরাল করার ইচ্ছা পোষণ করলেন। মেক্সিকো গিয়েছিলেন। দিয়েগো রিবেরা, ওরোসকো, সিক্যুরিয়স উল্লেখ করে বললেন, “আহা! কি ছবি করেছে ওরা মূরালে”। শিল্পীরা নিজস্ব ঐতিহ্য, চারিত্র্য সম্পর্কে সদা-সচেতন, নইলে আঁকায় স্বমহিমা  আসবে কি করে ! বললেন, “আমাদের দেশের মাটির হাঁড়ি কুড়ি, পাত্র – কতো রকমের, কতো বিচিত্র শেপের। পৃথিবীর কম দেশে পাবে।“  “ মেক্সিকোতে একদিন আমার গায়ে খদ্দরের একটা জামা ছিলো। একজন হাত দিয়ে নেড়ে ব প্রশংসা করে বললো, এরকম জিনিশ তারা আমদানী করতে পারে।“ “The Yankees have money, we got culture. They must come.”

478f2337b7ca91e9889fecf4b27eac8f-3তখন ১৯৬৫ পার হয়ে গেছে। আমি হয় মগবাজারে নয় ফজলুল হক হলে। একদিন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আর্ট একজিবিশন দেখতে গিয়ে জয়নুল আবেদীন-এর দ্যাখা। তিনিও এসেছেন। প্রদর্শনীর মধ্যেখানে ইজেলের উপরে সাজানো তাঁর এক জল্ররঙা ছবি। দাম নেই, অকশনে। শুনেছিলাম ইস্পাহানি পাঁচ হাজার টাকায় কিনেছিলো। তাঁর সঙ্গে  প্রদর্শনী ঘুরে দ্যাখার সৌভাগ্য হলো । রশীদ চৌধুরীর খুব প্রশংসা করলেন। “আমাদের দেশের একমাত্র শিল্পী যার ছবি ল্যুভে আছে”।

১৯৬৯ আমি ইসলামাবাদে পড়তে যাই। ১৯৭১-এর প্রথম দিকে ঢাকা ফিরি। তখন  স্বাধীনতার যুদ্ধ। মাঝে মধ্যে মধুর ক্যন্টিনে আড্ডা দিই – আবুল হাসান, জাকি সালাহউদ্দীন ইত্যাদি। স্বাধীনতা এলো। ১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারির জন্য জাকি সালাহউদ্দীন-এর উদ্যোগে একটা লিটল ম্যাগাজিনের চিন্তা করা হলো। আবুল হাসান নাম দিলো, “কাক” – টেড হিউস-এর কাব্যগ্রন্থের  নামানুসারে। আমি বললাম, “শোভার জন্য ভিতরে আরটিস্টদের ছবি দিতে হবে। আমি জোগাড় করে দেব।“ প্রচ্ছদের আইডিয়াও আমার, কালোর উপরে শুধু “কাক” লেখা [ করেছিলো আবুল বারক আলভি ]।  শফিউদ্দীন আহমেদ, কাম্রুল হাসান-এর কাছে থেকে ছবি সংগ্রহ করলাম। কিবরিয়া সাহেব দিতে চাইলেন না। একদিন জাকি-কে নিয়ে জয়নুল আবেদীন-এর বাসায় গেলাম, সেই একই গলিতে। এবার আগের বাড়ির পাশেই আরেকটি নতুন একতালা পাকা বাড়ি । ঢুকতেই বাইরের ঘরে দু-তিনটে মডার্ন অ্যাবস্ট্র্যাক্ট ছবি। উনি আসতেই, বললাম –“এগুলো তো আপনার ছবি নয়”। উনি একটু তাকালেন। বসার পর ওনার পুরনো কথা – মেক্সিকোর দিয়েগো রিবেরা, ওরোসকো, সিক্যুরিয়স  -এঁদের নিয়ে কথা পাড়লাম। বললাম, “আমরা একটি ২১-শে ফেব্রুয়ারির পত্রিকা করতে যাচ্ছি, নাম “কাক”। কাক আঁকার শ্রেষ্ঠ শিল্পী আপনি। একটা কাকের ছবি পেলে আমরা খুশী”। উনি রাজি হলেন এবং ক’দিন পরে আসতে বললেন। জাকি গিয়ে ছবিটা নিয়ে এসেছিলো। “কাক”, ১৯৭২-এর  জয়নুল আবেদীন কৃত ছবিটি নিচে দেয়া হলো। পত্রিকাটি প্রকাশ হবার পর ওঁর জন্য কপি নিয়ে গিয়েছিলাম। দেখে খুশি হয়েছিলেন, ম্যাগাজিনটির মানের প্রশংশা করেছিলেন এবং আরো কিছু কপি চাইলেন তাঁর ময়মনসিংহে  প্রস্তাবিত তাঁর কাজের মিউজিয়মের জন্য। ১৯৭২-এর সেপ্টেম্বরে আমি আমেরিকা চলে আসি। তারপরে শিল্পীর সঙ্গে আমার আর দ্যাখা হয় নি।

“কাক” পত্রিকা নিয়ে একটু বলি। সব কবিতা ছিলো যা প্রধানত আবুল হাসান যোগাড় করেছিলো। শামসুর রাহমান-এর পরিচিত চার লাইনের কাক কবিতাটি এই  সংকলনেই প্রকাশিত হয়েছিলো।

16996708_1600701306625747_1952762535_n1011  

কাক / শামসুর রাহমান

গ্রাম্য পথে পদচিহ্ন নেই। গোঠে গরু
নেই কোনো, রাখাল উধাও, রুক্ষসরু
আল খাঁ খাঁ, পথ পার্শ্বে বৃক্ষেরা নির্বাক
নগ্ন রৌদ্র চতুর্দিকে, স্পন্দমান কাক, শুধু কাক।

সৈয়দ শামসুল হক, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, হুমায়ুন আজাদ-এর কবিতা ছিলো। হাসানের তো বটেই। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-এর তিনটি ছোট কবিতা ছিলো। তার মধ্যে একটি

 নিবাস/ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

ঘরে এলে বাহির আমায় ব্যাকুল হয়ে ডাকে
বাইরে গেলে গৃহের দীর্ঘশ্বাস
আবার আমায় উতল করে পায়ের ফাঁকে ফাঁকে
কোন নরকে স্থায়ী আমার বাস ?

জয়নুল আবেদীন-এর চিত্রকর্মের আলোচনার স্থান এটি নয়। তবু, তাঁর প্রধান শক্তি ছিলো রেখা এবং “মিনিমালিটি”। স্বল্প ক্ষিপ্র টানেই, অল্প রঙে  তিনি বেগ ও সংবেদন সৃষ্টি করতে পারতেন। তাঁর জীবনের কাজের চারটি অধ্যায় আছে। ১। প্রথম জীবনে বাঁশপাতা কাগজের উপর  কালো ব্রাশে আঁকা তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের ছবি। ২। পঞ্চাশের দশকে রাঙামাটি দেখে, ফিরে সাঁওতালদের এবং প্রকৃতির চিত্রণ। ৩। ইউরোপ ঘুরে এসে আংশিক বিমূর্ত মডার্ন ছবি। ৪। সত্তরের পরে মোম ব্যবহার করে কালো কালির ছবি এবং মুক্তি যুদ্ধের চিত্রণ। তাঁর বড় অবদান বাংলাদেশে চিত্রকর্মের ঐতিহ্য স্থাপন, তরুণদের শেখানো, শেখার পীঠ নির্মাণ। এ ব্যাপারে তিনিই ছিলেন প্রধান কর্মী এবং উদ্যোগী পুরুষ। তবে, ছবি আঁকতেন বলে – মানে প্রতিকৃতিকার ছিলেন বলে মোল্লারা তাঁর ড়িতে ঢিল ছুঁড়েছিলো। একথা তিনি আমাকে বলেছিলেন। বাংলায়  বেঙ্গল পেইন্টিং নামে যে ধারা শুরু হয়েছিলো, তাতে জয়নুল আবেদীন একটি নতুন মাত্রা সংযোজন  করতে পেরেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পথ মোগল মিনিয়েচার থেকে, যাতে  তিনি জাপানী ওয়াশ যোগ করেছিলেন। সেটা যদি একটু রাজসিক হয়, আবেদীন একেবারেই বাঙালি নদী-মাটির। তাঁকে চিত্রকর্মের বিভূতিভূষণ  বলা যেতে পারে । আবার, বিমূর্ত ছবিগুলো স্মরণ করলে আধুনিকতা ও পথের পাঁচালি মেশানো আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও বলা যেতে পারে। ওঁকে নিয়ে আমার দুটো রুবাই কবিতা আছে, যা নিচে মুদ্রিত হলো। 

17012487_1600701819959029_1402240516_n

উস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ-র সঙ্গে জয়নুল আবেদীন, ঢাকায়।

জয়নুল আবেদীনের মোনাজাত

মন্বন্তরের মৃত এঁকে, আমি সত্যি বেদাদ? গুণাগার হয়েছি কি প্রভূ?
তাদের হাড়ের মধ্যে রুহু ডাকা সাধ্যাতীত, বান্দা তা দিতে পারে কভু?
তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী? সে কথা কি মূর্খও কোনদিন ভাবে!
দেশের স্বজন ওরা, হায়াত তোমার হাতে – মমতায় এঁকে গেছি দুঃখগুলো শুধু!

জয়নুল আবেদীন

আত্রাইয়ের ঢেউ তুলে রেখে দ্যান গুণটানা মাল্লার গা-র মধ্যেখানে ;
তেতাল্লিশে বুভুক্ষুর কৃশদেহে, ধূর্ত কাকে দিয়ে দ্যান অন্তঃশীল জীবনের মানে।
কি ভাবে জাড্য চাকা তোলা যায় কর্দম থেকে – পেশি, পরিশ্রম, সততায়
শিখিয়েছিলেন। হায়! নাগরিক, নব্য-নবিশেরা আজ তার কতটুকু জানে !

 

ওমর শামস

জন্ম : জুলাই ১৬, ১৯৪৭’ বিরল, দিনাজপুর। লেখার শুরু ষাটের দশকের শেষভাগ থেকে। প্রথম বই বোধিবৃক্ষতলে (১৯৮৪)। একটি সংকলন সহ ১০ টি কবিতা গ্রন্থ প্রকাশিত। শিক্ষা : ফিজিক্স-এ পি এইচ ডি জীবিকা : নাসা এবং এ টি এন্ড টি-তে চাকরি করে অবসরপ্রাপ্ত। ১৯৭২ সন থেকে বিদেশে। এখন গ্লোবাল বাসিন্দা। কবিতা গ্রন্থ : বোধিবৃক্ষতলে (১৯৮৪), খোয়াবনামা (১৯৮৬), সত্তুরের মিছিল (১৯৮৯), রিলকের আসা যাওয়া (১৯৯২), কৃতি প্রতিকৃতি ও অন্যান্য কবিতা (১৯৯৮), বাবরের পদ্ম অশোকের চাকা (২০১০), ইন্টারনেট গায়ত্রী (২০১০) , অনন্তর পান্না (২০১১), [কবিতা সংকলন] , নিউইয়র্কে যিশু (২০১২), ও ওমর ও বোরহেস(২০১৩) । হাইব্রিড মুরগি (২০১৪) [প্রকাশিতব্য] , যযুধান আসমান (২০১৫) [প্রকাশিতব্য]

লেখকের অন্যান্য পোস্ট

Tags: , , , , ,

লেখকের অন্যান্য পোস্ট :

সাম্প্রতিক পোষ্ট