সাম্প্রতিক

হাড়ের বিষাণ । রোমেল রহমান

বাতাসে পালক উড়ে গেলো।  পাখিদের খোঁজ তবু নেই।  চারিদিকে বেদনার মশাল মিছিল তবু কোথাও ক্ষোভের শিস নেই।  একটি পাখির দেখা পেলো না কোথাও কারো চোখ।  তারপর অনুভব হয় দিকেদিকে সুর নেই, ডাক নেই, নেই গান! চারিদিক ধুধু এক মরু।  কেবল বাতস কাঁপে, কাঁপে পাতা, ব্যথার বেহাগ।  ঠোঁট গোল করি, শঙ্খের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে সন্ধ্যা নামাই, তবু পাখিদের পালকের গন্ধ ফেরে না।  ডালে ডালে কল্লোল নেই, কেবল অন্ধকার ঘন হয় থকথকে রক্তের মতো জমে ওঠে।  চ্যাটচ্যাটে মনে হয় বেঁচে থাকা। 

পায়ের তলায় লেগে থাকে পিছুটান।  আগাতে আগাতে থেমে যাই।  বিশ্বাস ছিল একদিন বিহঙ্গের স্বাধীনতায়।  আজ জানা গেলো পাখিদের ঠোঁট বেঁধে দিলে ঘৃণায় ফেরে না তারা ঘরে।  সুদূরের দিকে যায় সকল অতীত করে সাজানো গোছানো ঘরে বেদনা ছড়িয়ে।  মন তবু পাখিদের গল্প শুনতে ভালোবাসে।  পাতার মধ্যে আঁকা পাখিদের ছবি দেখে মনের ডানায় আস্থার ওম জমা হয়।  যখন সে জানে সেই ডানা বিরোধী বারুদে পুড়ে অঙ্গার হয়।  তখন কোমল মন পৃথিবীর বুকে কান পেতে হুহু করে কাঁদে।  তারপর বৃষ্টির মতো পালক ঝরার দিন আসে, আকাশের থেকে ঝরে পালকের হাহাকার।  শোকপ্রস্তাবে কেউ কেউ লেখে পাখিদের জন্য এক পৃথিবীর দাবি।  বানোয়াট মনে হয় নিজের এমন বিশ্বাস।  আরোপিত মনে হয় চোখের সকল দেখা।  ভোজবাজী মনে হয় মাহুত যে পথে নিয়ে যায়।  অক্ষম মনে হয় সব চিৎকার।  ধূর্তের প্রহ্লাদ মনে হয় দিকেদিকে আজ।  খোয়াববাজীর শেষে নিজেকে লুকাতে খুঁজি আরাধ্য গুহা।  সব শেষে ভেঙে ফেলবার সাধ টিমটিমে প্রদীপের সলতের মতো হয়ে আসে।  বৃক্ষের সকল শাখায় মৃত্যুর কোলাহল ছড়িয়েছিটিয়ে দেই।  নিভে যাক বেসুরের দিন। 

গোঁয়ার ষাঁড়ের দীর্ঘশ্বাস উন্মাদ হয়ে ফুঁসে উঠে সহসা তুফান তোলে।  পাগলের আঙুল পাখির হাড়ের বাঁশি তুলে নেয় ঠোঁটে।  অনেক শতক পরে যেন এইখানে সুর বেজে ওঠে! বেজে ওঠে ভয়ানক ক্রন্দন হাড়ের বিষাণে।  তুমুল জন্মব্যাথা শোনা যায় সুরের আঘাতে।  চুরমার হয় শ্রুতি।  নিথর উঠানে ওঠে ঝড়।  যেন ইস্রাফিলের মহাসুর।  তারপর তাজ্জব ঘটে যায় যেন, কম্পিত হাওয়ায় হাওয়ায় হাড়ের বাঁশির থেকে বের হতে থাকে শত শত পাখি, পাখির ছায়ার থেকে জন্মায় আরও আরও পাখি।

ঝলসানো মাংসের ঘ্রাণে আমাদের প্রতিটা দিনের শেষ নামে।  সমস্ত মাটির পরাণে আজ ঝলসানো মাংসের উল্লাস।  সব্জির বাগানেও রক্ত জড়ানো পালকের ব্যথা।  প্লেটে প্লেটে দগ্ধ পাখিদের ঘ্রাণ।  হৃদয়ে সকলে আজ ফাঁদ পাতা শিকারির মতো।  ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলা ভ্রুনদের নিষ্পাপ দেহে মত্ত প্রেমের লাভা লেগে থাকে যদি, সেই প্রেম মাংসলোভীর।  নাগরিক মন আজ সবটুকু লুফে নিতে চায় লহমায়।  একটির সঙ্গে একটি ফাউ পেতে ভালোবাসে।  বিনিময় মূল্যে সকল ভয় আজ।  দায় নেবে কে? কার? কোথায়? কখন? কেন? কোন দুখে? পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে রাজি নই।  চারদেয়ালের কক্ষে সকলেই রাজা হয়ে রাণীর শরীর সেঁকে ঘুম যেতে চাই।  পাখিদের ছায়া কিনি শূন্য খাঁচায়।  মুখে বলি পাখিদের গান। 

ডানার জীবন চাই এইসব মুক্তির বচন ছড়িয়ে, পরস্ত্রীপ্রেমের খেলা খেলি।  নিজের কণ্ঠ বেঁচে দিয়ে দেয়ালে পাখির ছবি আঁকি।  তারপর একদিন খবর শুনতে পাই, পাখিদের গান গাইবার দিন শেষ।  বেঁধে দেয়া সুরে সুর তুলবার দিন এসে গেছে।  কেউ যদি বুকের পিপাসা টের পেয়ে পরাণের সুরে শিস দেয় তার ঠোঁট সেলাই দেবার এক অদ্ভুত ফরমান।  তাই অভিমান করে পাখিতে পাখিতে করে সব জানাজানি।  বিদায় বিদায় বলে পাখিদের আত্মহনন।  সবুজ পাতায় দেখি শোকের মাতম।  ভোরের আকাশ বেয়ে একঝাঁক ঘুঙুরের পাখি শেষবার উড়ে যায় মরা জোছনার ঘ্রাণে।  তারপর এইখানে নিরব মৌন এক জীবনের সারিসারি খিলান থমকে থাকে।  বিজয়ী সম্রাট সহসা আঁতকে ওঠে নিজের পায়ের শব্দে নিজেই।  কারো কি ইচ্ছে হয় না বোবারাজ্যে একঝাক পাখি ছেঁড়ে দিতে? হাওয়ার মধ্যে জীবনকে ছন্দের আঘাতে জাগাতে?  বোবা পাথরের এই ঘেরাটোপে বেঁচে থাকা যেন এক ঘানিটানা বলদের সুখ।  টিভি পর্দায় দেখি রাজকুর্নিশ ঠুকে একদল বয়সী সুরের পাখি রাজকীর্তন গায়। 

যেই সুর শুনে ঘৃণার ওষ্ঠে থুতু দেই।  নিজেকে নিজের কাছে মনে হয় ক্লেদের সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকা ক্লান্ত কাছিম।  তবু খোয়াবের খোঁচানিটা নিয়ে কেউ কেউ চুপিচুপি পীলসুজে উস্কানি দেয়।  আলোর ঝটকা এসে লাগে মুখে মুখে।  ব্যর্থতার শেষবেলা কড়া নাড়ে দুয়ারের বুকে।  পরাস্থ মানুষের এইটুকু আশ্বাস তাজা হয় শুধু যেদিন শহরে এক আচমকা উধাও হওয়া পাগলের ফিরে আসা ফেরে।  হাতে তার হাড়ের বিষাণ।  বুকে তার দলা দলা সাহস মজুদ।  কাউকে সে দেয় না নিজের ভাগ।  তোয়াক্কার নেই বেরিকেট।  সব যে দিয়েছে ঢেলে তার আর দেবার কি থাকে? তাই একদিন বাধ্যগত নিয়মের চৌখুপি ভেঙে দিতে চিৎকার দেয় কেউ।  ঘুমভাঙা পাখিটির হাহাকার যেন তার আর্তির সুরে।  সেই অপরাধে তাকে নিয়ে গেলো কিছু বোবা ফেউ আঁধারের থেকে আরো তুমুল আঁধারে।  শেষতক আমরা জেনেছি শুধু নিহতের কণ্ঠের পিপাসায় সন্তানের সঙ্গে বেঁচে থাকবার লোভ ছিল।  মানুষ নিহত হলে সভ্যতার ক্ষয় হয় একটি পালক পড়ে খসে! শাখায় শাখায় দোলে বাতাসের শোক।  সেই শোকে ফিরে আসা পাগলের বুকে বিষাদের জাগুয়ার থাবা গেঁড়ে বসে।  

গোঁয়ার ষাঁড়ের দীর্ঘশ্বাস উন্মাদ হয়ে ফুঁসে উঠে সহসা তুফান তোলে।  পাগলের আঙুল পাখির হাড়ের বাঁশি তুলে নেয় ঠোঁটে।  অনেক শতক পরে যেন এইখানে সুর বেজে ওঠে! বেজে ওঠে ভয়ানক ক্রন্দন হাড়ের বিষাণে।  তুমুল জন্মব্যাথা শোনা যায় সুরের আঘাতে।  চুরমার হয় শ্রুতি।  নিথর উঠানে ওঠে ঝড়।  যেন ইস্রাফিলের মহাসুর।  তারপর তাজ্জব ঘটে যায় যেন, কম্পিত হাওয়ায় হাওয়ায় হাড়ের বাঁশির থেকে বের হতে থাকে শত শত পাখি, পাখির ছায়ার থেকে জন্মায় আরও আরও পাখি।  সেই পাখি থেকে সুপ্রচুর পাখিদের ঝাঁক।  চারিদিক ভরে ওঠে কল্লোলিত সুরে।  

ঝুমঝুমি, ঘুঙুরের মত উল্লাস।  পাখির মিলিত সুরে ভেঙে পরে শৃঙ্খলিত সকল দুয়ার।  মৃত্যুঘটে সিংহাসনে বসে থাকা জল্লাদের।  পৃথিবীর বুক ভরে বাজে প্লাবনের বাঁশি, সুরের নহর।  পাতায় পাতায় জেগে ওঠে ক্রন্দন।  সেইক্ষনে মনে হল জীবনের এই এক অদ্ভুত ফলাফল, কঠোর দেয়াল ভেঙে পরে নির্জনতার অভিঘাতে।  মুখ বেঁধে মৌনতা আনা যায় না তো।  শৃঙ্খল দিলে ভাঙার বাঁশিটি জন্মায়।

রোমেল রহমান

কবি। গ্রন্থ: বিনিদ্র ক্যারাভান (২০১৫)

লেখকের অন্যান্য পোস্ট

লেখকের সোশাল লিংকস:
FacebookGoogle Plus

Tags: , , ,

লেখকের অন্যান্য পোস্ট :

সাম্প্রতিক পোষ্ট