সাম্প্রতিক

কনফেসন । রুখসানা কাজল

আজকাল মাঝরাতে সূচিতার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে। এমনিতেও তেমন ঘুম হয় না তার। তাই স্বপ্ন বা   দুঃস্বপ্ন কিছুই দেখে না সে। কিন্তু ঘুম ভাঙতেই লালকালো পিঁপড়ের মত অতীতরা ফিরে ফিরে আসছে। লাইন ধরে আসে একেকটা অতীত। সূচিতার কাছে এসে লাইন ভেঙ্গে ওরা ঢুকে পড়ে ওর মগজের ভেতর।    

মগজের নরম জমিনে হুল ফোটায়। পিলপিলিয়ে হেঁটে বেড়ায় বিছানা বালিশ ওর নাকে মুখে  চোখে।  মড়া গন্ধে ভরিয়ে দেয় চারপাশ। ইদানিং ভয় পায় সূচিতা । তবে কি কনফেসনের সময় এসে গেছে ? এই কি মৃত্যু লক্ষ্মণ ! এই মধ্য ছেষট্টিতে ? সে যে বাঁচতে চায় ! আরও আরও দিন রাত মাস বছর !  

ঘি রঙ জ্যোৎস্না খেলে বেড়াচ্ছে ছাদ থেকে ছাদে। পানির গ্লাস হাতে সূচিতা থেবড়ে বসে পড়ে  জানালার পাশে। এরকমই এক মধ্যরাতে সে বসেছিল ঠিক এভাবে । বছর তেত্রিশ আগে।  

মোতাহার  এসেছিল সেদিন দুপুরে । একা। সূচির বেগুনি কাফতান লুটিয়ে পড়েছিল সুখে । কবি ও কবিতা মন্থনে পাগল হয়ে মোতাহারের  বুকের উপর মুখ রেখে আকুল হয়ে কেঁদেছিল সূচি, চল পালাই আমরা।

তোমার ছেলেমেয়ে ? সশংকিত মোতাহার।

আমার জন্যে কে ভেবেছে যে ওদের কথা ভাবব ? কে বোঝে বুড়ো ভাম মানুষটার পাশে   সারারাত বালিশ কামড়ে পড়ে থাকার কষ্টকে ? আমার আগুন সে তো একাই পোড়ে। কি সুখ একা পুড়ে ! কবে পালাবে মোতাহার ?   

ডাক্তার জানালো হার্ট হ্যাটাক। বাড়ি ভরে গেছিল কান্নায়। সূচি খাট ছুঁয়ে থেবড়ে বসেছিল আতঙ্কে। কাঁদেনি। কাঁদতে পারেনি ভয়ে। কেবল কাঁপছিল। সূচি দেখেছিল, ছেলের চোখ জোড়া জ্বল জ্বল করে উঠেছিল কি এক ভাবনায় ।       

 ঠিক সেই সময় ডোরবেল বেজে উঠেছিল । দ্রুত কাফতান পরে দরোজা খোলে  সূচিতা। তার ছেলে । বছর পনেরোর কিশোর। তার হাতে গাছপাকা এক কাঁঠাল। ম ম গন্ধ আলো ছড়াচ্ছে ছেলের কালো মুখে।   

আসি সূচিপা, টুক করে বেরিয়ে যায় মোতাহার।

ছেলের অনুরোধে কাঁঠালের গায়ে ছুরি বসাতেই এসে পড়ে লোকটা, তুমি কাঁঠাল ভালবাস তাই নিয়ে এলাম। শুভ জন্মদিন সূচিতা।  

রাগে দুঃখে সূচির হাত চলে কাঁঠালের গায়ে আর মন হাঁটে খুনের রাস্তায়। সেই কোন যুগে সে   কাঁঠাল ভালবাসত ! এখন কতকিছু বদলে গেছে। কিছুই কি বোঝে না আবাল বুড়োটা ? পুরুষরা নাকি দ্বিচারিণী, তৃচারিনীদের সহজেই বুঝতে পারে! লোকটা কাঁঠাল আর সূচিকে এক ফ্রেমে ফেলে রেখেছে সেই কতকাল আগে । চেয়েও দেখে না সূচি আর নেই সেই ফ্রেমে !  

খচখচ করে কাঁঠালের আঁশ কাটে আর ভাবে, গুয়ের মাছি এরচে বেশি আর কি বুঝবে !  কুমড়োফুল পেলেও এনে বলত, শুভ জন্মদিন সুচিতা। যাও, এক্ষুনি ভেজে আনো। আমরা গপগপিয়ে খেয়ে ফেলি তাই না বাবা !

যে গাছের যে ছাল ! ছেলেও মাথা নাড়ত কুমড়োফুল খাওয়ার আনন্দে।    

গলা পর্যন্ত কাঁঠাল খেয়ে ঘুমিয়ে গেছিল লোকটা । সূচি জানত ঘুমের ভেতর পানি খাওয়া লোকটির  একান্ত অভ্যাস । সাঁঝরাতে শুধু একবার বলতে পেরেছিল, আঃ সূচি কি দিলে—  

ডাক্তার জানালো হার্ট হ্যাটাক। বাড়ি ভরে গেছিল কান্নায়। সূচি খাট ছুঁয়ে থেবড়ে বসেছিল আতঙ্কে। কাঁদেনি। কাঁদতে পারেনি ভয়ে। কেবল কাঁপছিল। সূচি দেখেছিল, ছেলের চোখ জোড়া জ্বল জ্বল করে উঠেছিল কি এক ভাবনায় ।   

শত ডাকেও আর আসেনি মোতাহার। সূচির তখন মুক্তির আনন্দে অমলতাস শরীর। বিয়ে করে ফেললো অসম এক তরুণকে। সে বিয়ে ভেঙ্গে গেলে আবার অসমের সাথে ! ছেলেমেয়েরা নানাবাড়ি খালাবাড়ি আঁকড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

পচিশ বছরের সন্তানহীন তৃতীয় বিয়ে ভেঙ্গে সেই ছেলের বাড়িতে উঠে এসেছে সূচি। ছেলে কথা  বলে না। অযত্নও করে না। কেবল মাঝে মাঝে সেই চোখে তাকিয়ে থাকে।

ছেলে কি কিছু দেখেছিল সেই বিকেলে ?

রুখসানা কাজল

জন্ম ২৩ নভেম্বর, গোপালগঞ্জ। ঢাকায় বসবাসরত। একটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের রাস্ত্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। বেরিয়েছে চারটি বই -- 'তোমার জন্যে মেয়ে' অনুপ্রাণন প্রকাশনী। 'আহা জীবন'- চিত্রা প্রকাশনী। 'নুনফল গল্পগুলি' রসেবশে প্রকাশনী কলকাতা, 'জলের অক্ষর' নালন্দা প্রকাশনী। ইমেল : rukhsanakajol@yahoo.com

লেখকের অন্যান্য পোস্ট

লেখকের সোশাল লিংকস:
Facebook

Tags: ,

লেখকের অন্যান্য পোস্ট :

সাম্প্রতিক পোষ্ট