সাম্প্রতিক

তিনটি অ-কবিতা । খালেদ ঊদ-দীন

১.- হৃদপুর জং

ট্রেন থামার কথা ছিল, কিন্তু থামেনি। এমন এর আগে আর কখনও হয়নি। ট্রেন তো স্টেশনেই থামে। জিরোয়। আবার ছুটে। আবার থামে। আবার ছুটে। তো, এ ঘটনা দ্রুত লোকমুখে নানা কিংবদন্তির জন্ম দেয়। আকাশে বাতাসে রটতে থাকে যুক্তি রহস্য ভাব ও রোমান্সের ষোলকলা। কান ভারি হলো। আড্ডায় প্রাণ সঞ্চার হলো। কিন্তু যে বসেছিল প্রতীক্ষায়–সে আসবে বলে, তার মনে তখন রাজ্যের ভার। রাত পোহালেই পঞ্চায়তি বৈঠক। মীমাংসা হবে কে কার। সে ভাবছে…

যদি ট্রেন থামত! একজন একজন করে যখন নামতে  শুরু করত যাত্রীরা…অচেনা মুখের দিকে থাকিয়ে সে খোঁজতো সেই মুখ… এই তো নামল একজন, এই আরেকজন, তারপর একজন, দুইজন…না এর পরের জন… এভাবে একসময় শেষ যাত্রি নেমে যাওয়ার পর সে কি করত! তারচেয়ে ট্রেন যখন থামলই না, ভালোই হলো, কেবল প্রতীক্ষা সময় ভাড়লো! আশা থাকলো। আসবে, অবশ্যই আসবে। এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে সকল জঞ্জাল। দূর হবে অমঙ্গল। আগামীর পতাকায় ঝলঝল করবে রঙিন নবাগত উল্লাস।

হৃদপুর জংশন খুব পুরনো। এখন আর কোনও ট্রেন এই জংশনে থামে না।।

২. কাসিদা

আমি নিশিদিন তোমার নাম জপি গো তোমার নাম জপি…

চৈত্রের বেহায়া বাতাসের সঙ্গে তোমার পেরে না ওঠার দৃশ্যে হকচকিয়ে যাওয়া আবেগ ফানুসের মতো মিলিয়ে যায় নি, বরং পিছু নিয়েছে। ভাবখানা এমন, নিত্য দেখা বায়স্কোপ আজ বড় এলোমেলো…কোথায় যেন হারিয়েছে একটা আধুলি, গেল বসন্তে।

আমি নিশিদিন তোমার নাম জপি গো তোমার নাম জপি…

নাটকপাড়ায় মহড়াকক্ষে একনিষ্ট প্রচেষ্টা চলছে…আনমনে যে তাকাই, সে সাহস নাই…

তোমার নাম জপি গো তোমার নাম জপি…

ছোটো বড় কিংবা সমবয়সী হলেও তৃতীয়জন সবসময় অসহ্য জেনেও তোমার একজন সঙ্গে রাখা অনাহুতই সব ধৌর্যের পরীক্ষক হিসেবে দণ্ডায়মান থাকে, না কি পাহারা দিচ্ছে সময় তোমার, ওগো প্রাণহারিণী…

আমি নিশিদিন তোমার নাম জপি গো তোমার নাম জপি…

চুপিচুপি স্পর্শ করলে পাপ হয় না, ওগো ময়না? এতো রেসপেক্ট তোমার সমাজবিধির… কান পাতো, শোনা যাচ্ছে–ধূলিঝরের শব্দ?

আমি নিশিদিন তোমার নাম জপি গো তোমার নাম জপি…

তোমায় দেখেছি ভোর, দুপুর; তোমায় দেখিব সন্ধ্যা…

আমি নিশিদিন তোমার নাম জপি গো তোমার নাম জপি…

৩. দ্রষ্টব্য

বর্ষার দুপুর। রৌদ্রজ্জ্বল আকাশ। আষাঢ়ে গরম। একটু দূরে…কোলাহলের বাইরে। অনেক দিন পর, দুজনের দেখা। মাতার উপর এক আকাশ নীল। বয়ে যাওয়া ঘোলাজলের খরস্রোতা নদী সামনে নিয়ে কোনও কথা না বলে দুজনে চুপচাপ। দুজনের শ্বাস-প্রশ্বাস হারিয়ে যাচ্ছিল চুরিকরা সময়ের গহ্বরে। কালই ফিরতে হবে, কর্মযন্ত্রণায়। যেখানে দিনের শুরু আছে, শেষ নাই। ঘামের বিন্দু বিন্দু ফোটা মাস শেষে একত্র করলে যে হাহাকারের জন্ম দেয় তার নাম শোষণ। অথচ এই হাহাকারেরই অষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে আআছে বর্তমান ও আগামী। ও নদী তোমার প্রেমময় স্রোতে কেন ভাসিয়ে নিয়ে যাও সকল আহ্লাদী নির্মাণ!

এই যে শোন, তোমার স্পর্শে যেখানে জেগে ওঠার কথা নতুন চর অথচ তাকিয়ে দেখ, আকাশে জমতে শুরু করেছে মেঘ! ক্রমে কালো হয়ে আসছে চারদিক। আকাশে মেঘ দৌড়াচ্ছে, দৌড়াচ্ছে… বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়লে শেষ হবে মেঘের ক্লান্তি। আমিও তো দৌড়ের ওপর আছি, দৌড়াচ্ছি…দৌড়াচ্ছি। গন্তব্যে পৌছলে পরে তোমার আমার সংসার! এই যে, এতো বড় ফাঁকা মাঠ, কত বেগে দৌড়ালে পরে সময়মত পৌছতে পারব, জানা নাই। না কি আদৌ কখনও কেউ গন্তব্যে কোনও কালে পৌছতে পেরেছিল!

শোন তবে, শক্তকরে হাত ধরো। বৃষ্টিই তো হবে। হোক। এই তো! বৃষ্টি পড়ছে…আহা, একী বৃষ্টি, প্রবল বৃষ্টি। বৃষ্টির একটানা…। ভালোই হলো। কিছু ঘাম ধুয়ে মিশে যাক, পবিত্রজলে। তোমার কেন এতো ভয়! হাতের মুঠোয় যখন নিয়েছি প্রাণ, এই প্রাণের বিনাশ হবে না। আমরা ছুটব না, স্থির হয়ে বসে থাকব। হৃদয়ের সকল ক্ষরণ মুছে নিয়ে আমাদের চারপাশে মার্চ করে অভিবাদন জানাবে জাতীসংঘের সুসজ্জিত চৌকুশ বাহিনী। তোমার আমার নামে যে রাষ্ট্রের জন্ম হবে, অন্তত সেখানে কোনও বৈষম্য থাকবে না।

খালেদ উদ-দীন

পেশায়- শিক্ষক। পূর্ববর্তী কবিতাবই: রঙিন মোড়কে সাদা কালো (২০০৮) ভাঙা ঘর নীরব সমুদ্র (২০০৯) জলপাতালে মিঠে রোদ (২০১৫) নৈঃশব্দের জলজোছনা (২০১৭) শিশুতোষ: সুপারম্যান (২০১৬) কথা বলা পাখি (২০১৭) সম্পাদনা : বুনন (ছোটোকাগজ) পাপড়ি রহমানের 'নির্বাচিত গল্প' (২০১৭)।জন্ম ১০ মে ১৯৭৮ বিশ্বনাথ, সিলেট।

লেখকের অন্যান্য পোস্ট

লেখকের সোশাল লিংকস:
Facebook

Tags: ,

লেখকের অন্যান্য পোস্ট :

সাম্প্রতিক পোষ্ট