সাম্প্রতিক

বিড়ালপাখি । আহমদ সায়েম

ভাঙা-ভাঙা শব্দে কথা বলে তনুশ্রী। বয়স আড়াই বা তিন হবে। তার পাকা পাকা কথায় মনে হবে বুড়ি একটা।

যত বায়না— আবদার বাবার সাথেই সব। মাকে ভয় পায় তেমন কিছু না, তবে বাবাকেই গুরুত্ব দেয় তনুশ্রী।

পিঠের ওপর ঘোড়া চড়া, ট্যাবে গেম খেলা, বিছানায় শুয়ে-শুয়ে রান্নাবাটি খেলা বা গল্প শোনা সবই বাবার সাথে। এমনই একদিন শুয়ে-শুয়ে বাইরের জানালার দিকে তাকিয়ে বাবাকে জিজ্ঞাস করলো— বাবা, বাতাস নড়তেছে কেন?  

বাবা— গাছের পাতা মা!
—গাছের পাতা নড়বে কেমন করে বাবা? বাতাসের জন্য পাতা নড়তেছে।
—ও তাই তো, হ্যাঁ মা।

তনুশ্রী আরো ভারী, আরো আদুরে গলায় বলল— তুমি কিচ্ছু বোঝ না, তুমি ‘টম’হয়ে যাচ্ছ বাবা।

বৃষ্টি হচ্ছে এমন সময় বাবার ঘরে ফেরা। তনুশ্রী— এদিকে আসো বাবা, এই দেখো— আমাকে তো খালি-খালি বকা দাও। এখন বৃষ্টিকে বকে দাও দেখি!

—কেন মা? বাবা অবাক হলেন।
—দেখতেছ না বৃষ্টি আমাদের জানালা, ঘর সব ভিজায়ে দিছে।
—তাই ত! বৃষ্টির কী সাহস!
— বৃষ্টি এইরকম সবার ঘর ভিজায়ে দেয়, বাবা?
 হুম!
—কেন? কেউ বৃষ্টিকে বকা দেয় না?
না।
তুমি বকা দিবে।
আচ্ছা, মা।
এখনি দাও….

বেড়ানোর জন্য তনুশ্রীড় প্রিয় জায়গা নানুর বাসা। ও ওই জায়গাটাকে  ‘নাইকল দাদুর বাসা’ নামে ডাকে। মূলত জায়গাটার নাম রায়নগর। কিন্তু সে তা শর্টকাটে ‘নাইকলদাদুর বাসা’বলে চালিয়ে দেয়। তার এই শিশুমুখো নামটা নানুরও খুব প্রিয়। ‘নাইকলদাদু’ বলা মাত্র নানু তাকে আদরে জড়িয়ে ধরেন। কিন্তু নানুর আদরের চেয়েও তনুশ্রীর আগ্রহ অন্যখানে। নানুর বাড়িতে পাখি আছে একজোড়া। হাঁস আছে, মুরগী আছে। বিড়াল আছে। ছুটির দিনে এরা হলো তনুশ্রীর খেলার সাথী।

 এইদিকে নানুর বাড়িতে শাদা ও সোনালি রঙা দুইটা বাচ্চা হয়েছে বিড়ালের, যা দেখে তনুশ্রী বায়না ধরে বসলো, ছানা দুইটার একটাকে সে বাসায় নিয়ে যাবেই। তার বায়না মানে— অটল, নাছোড়! ফেরানো যাবে না কোনোভাবেই। অতএব বিড়ালের একটা বাচ্চা সাথে নিয়ে ফিরতেই হলো ঘরে।

ঘণ্টা দুয়েক পরে যখন বাসায় ফিরার সময় হলো, দেখা গেল বিড়াল-পাখিটা নাই! মা-বিড়াল আছে। সোনালী বিড়াল ছানাটি আছে। হাঁস আছে। মুরগী আছে। এক জোড়া পাখি আছে। শুধু বিড়াল-পাখি নাই! কোথায় গেল? তনুশ্রীর খুব কান্না পেল। অনেক খোঁজা হলো। কিন্তু বিড়াল-পাখির দেখা পাওয়া গেল না আর।  দেখা গেল, মা-বিড়ালটি খুব রিল্যাক্সড হয়ে বসে আছে ঘরের একপাশে, তার সোনালী বিড়াল-ছানাটি নিয়ে। সবাই ব্যপারটাতে খুব অবাক হলো। অবশেষে  খোঁজাখুঁজিতে কোনো কাজ না হওয়ায়, তনুশ্রীর কান্নাকাটি ম্যানেজ করে নিজ বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো সবাই।

তনুশ্রী খুব খুশি। সারাদিন সে ছানাটি নিয়ে ব্যস্ত। সে বিড়ালছানাটির নাম দিয়েছে ‘পাখি’। তনুশ্রীর বাবা তনুশ্রীকে পাখি নামে ডাকে। মা-ও তাই। মানে এইবার ঘরে দুইটা পাখি হলো। তনু-পাখি। বিড়াল-পাখি। ‘আমার পাখিটা কই রে’ সারাদিন এই ডাকটা যেন ঘরের দেয়ালে দেয়ালে উড়ে বেড়ায়। 

নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে তনুশ্রী এখন তার পাখিটাকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত।  কিন্তু বিড়াল-পাখি সারাদিন ম্যাঁও-ম্যাঁও শব্দে ঘর মাথায় তুলে রাখছে। কোনোভাবেই  তারে শান্ত করা যাচ্ছে না। সে কি এইখানে ভাল নেই?

ছয়-সাত দিনের মাথায় ‘বিড়াল-পাখি’টাকে ফেরত দেয়ার জন্য নাইকল দাদুর বাসায় যাওয়া হলো।  বাচ্চাটা তার মা-বিড়ালকে পেয়ে নানান রকম খেলায় মেতে উঠল এবং মায়ের আদরে আদরে অনেকটা সময় পার করলো। বিড়াল-পাখি ও তনু-পাখি দুজনই এবার শান্ত।

তনুশ্রী নানুর সাথে নানান রকমের গল্প করছে।  আর  নানু তার সব কথাতে সায় দিয়ে যাচ্ছেন। নানু জানো— সেদিন আমি আর বাবা বৃষ্টিকে এত বকা দিলাম!

—কেন?
—ও কেমন দেখ! কিছু না বলে অন্যের ঘর, জানালা ভিজায়ে দেয়।
—ও তাই! হো হো হো…. নানু হেসে উঠলেন!

ঘণ্টা দুয়েক পরে যখন বাসায় ফিরার সময় হলো, দেখা গেল বিড়াল-পাখিটা নাই! মা-বিড়াল আছে। সোনালী বিড়াল ছানাটি আছে। হাঁস আছে। মুরগী আছে। এক জোড়া পাখি আছে। শুধু বিড়াল—পাখি নাই! কোথায় গেল? তনুশ্রীর খুব কান্না পেল। অনেক খোঁজা হলো। কিন্তু বিড়াল-পাখির দেখা পাওয়া গেল না আর।  দেখা গেল, মা-বিড়ালটি খুব রিল্যাক্সড হয়ে বসে আছে ঘরের একপাশে, তার সোনালী বিড়াল-ছানাটি নিয়ে। সবাই ব্যপারটাতে খুব অবাক হলো। অবশেষে  খোঁজাখুঁজিতে কোনো কাজ না হওয়ায়, তনুশ্রীর কান্নাকাটি ম্যানেজ করে নিজ বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো সবাই।

রাস্তায় তনুশ্রী বাবাকে একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলো।
পাখিটাকে কি কেউ কিডন্যাপ করল, বাবা?
কেউ লুকিয়ে ফেলল, বাবা?
বিড়াল-পাখিটা কি আমাদের সাথে আর থাকবে না?
বিড়াল-পাখি কি নিজে থেকে লুকিয়ে গেল, বাবা?
ও বাবা, বিড়াল-পাখিকে কেউ মারে নাই ত? 

বাবার পক্ষে এত সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেয়া সম্ভব হলো না। যা বললেন উত্তরে, তা তনুশ্রীকে মোটেও সন্তুষ্ট করলো না। মন খারাপ করে ভিজা চোখে তনুশ্রী ঘরের দিকে চললো।  

ঘরে ঢুকতেই তনুশ্রীর চিৎকার বাবাআআআ— আমার পাখিটাকে পেয়ে গেছি বাবা। পাখিটা একা একাই বাসায় ফিরে এসেছে।

পাখিটাকে পাখির কোলে দেখে তার বাবার চোখও ছানাবড়া।

রচনা :  ১৮ মে ২০১৮

আহমদ সায়েম

জন্ম ৫ জানুয়ারি ১৯৭৮। সিলেট সদর। তাঁর সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘সূনৃত’ সম্পাদনা করেছেন ২০০০ সাল থেকে, এবং অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা ‘রাশপ্রিন্ট’ (www.raashprint.com) ২০১২ সাল থেকে সম্পাদনা করছেন । কবিতার বই বেরিয়েছে তিনটি, প্রথম বই ২০১৫ ফেব্রুয়ারিতে ‘অনক্ষর ইশারার ঘোর’ ‘The layers of Dawn’ ২০১৮, এবং ‘কয়েক পৃষ্ঠা ভোর’ ২০১৯ সালে বের হয়েছে। বর্তমানে (7820 Summerdale AVE, Philadelphia, PA 19111) ফিলাডেলফিয়া, যুক্তরাষ্ট্র বাস করছেন। ফোন : +1 (929) 732-5421 ইমেল: ahmedsayem@gmail.com

লেখকের অন্যান্য পোস্ট

লেখকের সোশাল লিংকস:
FacebookLinkedInGoogle Plus

Tags: , ,

লেখকের অন্যান্য পোস্ট :

সাম্প্রতিক পোষ্ট